বিহার বাঙালি সমিতি: ৪৪তম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা

৪৪তম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা

বিহার বাঙালি সমিতির স্টল: 507

প্রতিবেদন / তন্ময় বীর

     এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় বিহার বাঙালি সমিতির অংশগ্রহণ নানান দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পিতভাবে বহু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে উপস্থিত হওয়ার সুগভীর তাৎপর্য আছে


     
...শুধু বাংলা ভাষা নয় অন্যান্য অনেক ভাষাই আন্তর্জাতিক ও জাতীয় চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তাদের গুরুত্ব ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে ব্যবহারিক জীবনে, অর্থনৈতিক দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে পড়তে সর্বনাশের কিনারে উপনীত বাইরের আঘাত যখন তীব্রতর হয় তখন ঘরের ঐক্য দৃঢ় না হলে সমূহ সর্বনাশ ভারতের ভাষাগুলির ক্ষেত্রে, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হলেও, বিষয়টি সত্য হয়ে উঠছে নানান রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির অংকে সংকীর্ণ ভাষাজাতীয়তাবাদের সুচতুর উপস্থাপনে প্রতিবেশী ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অনৈক্যর বীজ ব্যপ্ত হচ্ছে ...... বিহার বাঙালি সমিতির সভাপতি ডাক্তার দিলীপকুমার সিনহার সঙ্গে ভাগলপুরের একটি হোটেলের ঘরে এরকম ঘরোয়া আলোচনা চলছিল -



উপস্থিত ছিলেন শ্রীনীতীশ বিশ্বাস, শ্রীতপন সেনগুপ্ত (দিল্লি), শ্রীপ্রদীপ গাঙ্গুলি(দিল্লি), শ্রীবিদ্যুৎ পাল ও শ্রীসুনির্মল দাস এরকম ঘোরতর সংকটের আলোচনা আরো নানান ক্ষেত্রে, নানান সময় হয়েছে ‘কিছু করতে হবে’ - এরকম বুদবুদও মনে জেগেছে; কিন্তু সভাসমিতি থেকে ফিরে রুটি-রোজগারের তাড়নায় এবং ‘আর কী হবে!’ এরকম একটা মধ্যবিত্ত আলস্যের বিজৃম্ভণে সব ভুলে যাই সেদিন আমরা ভেবেছিলাম অনেক আরও অনেক করণীয় কাজের সঙ্গে আগামী কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় (২৯ জানুয়ারি – ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০) বিহার বাঙালি সমিতি অংশগ্রহণ করুক এবং তা নিম্নোক্ত কারণে –

১। বিহার বাঙালি সমিতির কার্যকলাপ, ইতিহাস-ঐতিহ্য ক্রমশ বাইরের জগতের কাছে বিস্মৃত হচ্ছে, তাকে আবার পরিচিতির আলোকে আনা।

 



২। বিহার বাঙালি সমিতির সঙ্গে যুক্ত বিহারের নতুন প্রজন্ম এই সমিতিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থিত দেখলে আরো উৎসাহিত হবে

৩। বিহারের বাঙালিই শুধু নয় পুস্তকমেলায় আগত বিহারের সব ভাষাভাষী মানুষের  সাংস্কৃতিক ঠিকানা হতে পারবে এই স্টল

৪। সমিতির কার্যকলাপের বিবরণ, সমিতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমিতি প্রাকাশিত পত্র-পত্রিকা, স্মরণিকা ও গ্রন্থাদি বৃহত্তর পরিসরে উপস্থাপন করা যাবে

৬। পুস্তকমেলায় বিহার বাঙালি সমিতির সদস্য/সদস্যাদের বা সমিতির পরিচিতদের বই পত্র-পত্রিকা সমিতির স্টলে রাখা যেতে পারে।

 

৭। সম্ভব হলে বিহার বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বইপত্র সম্ভব এই স্টলে রাখা হবে বিহার বাংলা একাডেমির নতুন সম্ভাবনার দিকগুলি এসবের মধ্য দিয়ে জাগ্রত হতে পারে

৮। প্রয়োজনে মেলার কোনো মঞ্চ ভাড়া নিয়ে বড়ো করে বহির্বঙ্গের বাঙ্গালী, তাদের সমস্যা, প্রকৃত অবস্থান, করণীয় ও বাংলা সংস্কৃতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে সেমিনার ও আলোচনা সভা করা হবে

৯। বেশ কিছুদিন আগে কলকাতা পুস্তকমেলায় লিটল ম্যাগাজিন বাংলা পত্র-পত্রিকার একটি নির্দিষ্ট কর্নার থাকতো, নানান কারণে তা উঠে গেছে, এমনকি বহির্বঙ্গের থেকে আসা পত্রপত্রিকার সংখ্যাও কমেছে। এই স্টল সেই অভাব পূরণ করতে পারে যে সব

পত্রপত্রিকা, সংস্থা দূরত্ব সময় বা ব্যবস্থাপনার কারণে মেলায় অংশ নিতে পারে না তাঁরা সমিতির এই স্টল ব্যবহার করতে পারে। 

১০। সামগ্রিকভাবে বিহারে বাংলা সংস্কৃতির পরিচয় সর্বভারতীয় স্তরে প্রসারিত করা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে সমগ্র বহির্বঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে শক্তিশালী ভাষাচেতনার অংশীদার হওয়া এর উদ্দেশ্য



 

        সত্যি অবাক হয়েছিলাম যখন এর কিছুদিন পরেই সমিতি থেকে জানানো হয় যে সমিতি কলকাতা পুস্তকমেলায় স্টল নেবে এবং আমাকে তার দায়িত্ব নিতে হবে। যে মুহূর্তে বইমেলা কর্তৃপক্ষ জানায় যে স্টল পাওয়া যাবে, সেই মুহূর্ত থেকেই সমস্ত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে বইমেলায় সমিতির উপস্থিতির খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পূর্ব-উদ্দেশ্যগুলি যাতে সিদ্ধ হয় তার জন্য সর্বপ্রকার উদ্যোগ নেওয়া হয় খুব সামান্য সময়ের মধ্যে অনেকগুলি কাজ করে ফেলতে হয় কিছু কিছু বই পত্রিকা আসে ডাকযোগে, কিছু হাতে হাতে। নাগাল্যান্ড আসাম ত্রিপুরা থেকে বই পত্রিকা এসে যায়, এসে যায় ঝাড়খণ্ড থেকে। সাড়া পাওয়া যেতে থাকে খুব আশাব্যঞ্জক রকমের সমিতির মুখপত্র সঞ্চিতা, হিন্দি প্রচারপত্র, বেহার হেরাল্ড ও অন্যান্য প্রকাশনা পৌঁছে যায় বইমেলা শুরু হওয়ার আগেই। এবারের স্টল ক্রমাঙ্ক ছিল ৫০৭ এবং এর অবস্থান ছিল খুব ভালো জায়গায় খুব কাছে ছিল লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু বইয়ের স্টল, দুটো প্রবেশ দ্বার দিয়ে সমানভাবে আসবার সুযোগ ছিল। আমরা চেষ্টা করি ভারতের বিভিন্ন জায়গার বাংলা পত্রপত্রিকা এবং কোন প্রচেষ্টা নেই বিভিন্ন রাজ্যের বাঙালি, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সম্বলিত বইপত্র পত্রিকা চেয়েছেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী গবেষকরা বিহার থেকে সমিতির শ্রীশিবনাথ চ্যাটার্জী, সস্ত্রীক শ্রীঅজয় স্যান্যাল, শ্রীঅঞ্জন ভট্টাচার্য, শ্রীআশিস ঘোষ প্রমুখ সদস্যরা নানান সময়ে স্টলে উপস্থিত থেকে স্টলের নানান দায়িত্ব না সামলালে আমার পক্ষে এই কাজ করা সত্যি দুঃসাধ্য হত, বিশেষ করে প্রথম কয়েকদিন বাংলাদেশে থাকার কারণে অনুপস্থিত ছিলাম। আমার দুজন ছাত্র শ্রীমান সুরেশ ও শ্রীমান শুভম দুটি পর্যায়ে স্টলের সব দায়িত্ব সামলেছে বলে আরো কাজের সুবিধা হয়েছে কবি শ্রীশান্তনু গঙ্গারিডির সর্বক্ষণিক উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। বিষেশভাবে স্টলে নানান সময়ে বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত থেকে, এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন এবং জ্বলন্ত সমাজ রাজনৈতিক সমস্যা, বহির্বঙ্গের বাংলা, বাঙালি ইত্যাদি নিয়ে স্টলের মধ্যে, স্টলের সামনে আলোচনা তর্ক-বিতর্ক জমিয়ে তুলেছিলেন। একদিন বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিলশ্রীশান্তনু গঙ্গারিডির ‘এখানেই আমাদের ঘর গেরস্থালি’ কাব্যগ্রন্থের উদ্বোধন, কবিতাপাঠ এবং ‘এই সময়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষার সমস্যা’ বিষয়ে আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন বিহার বাঙালি সমিতির সভাপতি ক্যাপ্টেন দিলীপকুমার সিনহা, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য, সমিতির সদস্য সদস্যা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আমরা দেখেছি বাংলার বাইরের পত্রপত্রিকা বই অনুবাদ-সাহিত্য পাঠকরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে কিনেছেন প্রশংসা করেছেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ আরো সুষ্ঠু ও পরিকল্পনামাফিক হোক তার জন্য শুভেচ্ছা দিয়েছেন বিহার বাঙালি সমিতি নিজস্ব বইপত্র অত্যন্ত কম থাকায় অন্যান্য প্রকাশক লেখকদের কাছ থেকে আসা বইপত্রের বিক্রি বেশি হয়েছে, কয়েকজন সমিতির সদস্য হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন।

         

         যে উদ্দীপনা এই স্টলকে কেন্দ্র করে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের  বাইরের অন্যান্য রাজ্যের বাঙালিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেলে উপরিউক্ত উদ্দেশ্যগুলি অদূর ভবিষ্যতে সফল হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিহার বাংলা একাডেমিকে পুনরায় সক্রিয় করার কাজে সমিতির ভাবনাচিন্তা আরো দ্রুত ও কার্যকরী হওয়া বাঞ্ছনীয়। সমিতির হাতে যেসব মূল্যবান দলিল ও বইপত্র আছে, যেগুলি আর সহজে পাওয়া যায় না, সেগুলি পুন:প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে বহির্বঙ্গের অন্যান্য প্রকাশক, লেখক ও সংস্থার সঙ্গে আরো নিবিড় যোগাযোগ করে বইমেলায় অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। সমিতির নিজস্ব যেসব এজেন্ডা আছে তার সঙ্গে এগুলো যুক্ত হলে ভালো হয় বলে আমার ধারণা। বাইরে ও ভেতরের সব কার্যক্রম মিলিয়ে সমিতির সেই অতীত উজ্জ্বল মহিমান্বিত দিনগুলি এইরকম নানান উদ্যোগকে কেন্দ্র করে আবার ফিরে আসুক এই কামনা করি। আগামী দিনে বইমেলায় বিহার বাঙালি সমিতি আরও বৃহৎ, পরিকল্পিত এবং সফলভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবে এই আশা রাখি।  

 *************

 


No comments:

Post a Comment

বর্ণপরিচয়