বর্ণপরিচয়


 

প্রয়াত অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।

 প্রয়াত অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।



পরিবার সূত্রে খবর, ২২ তারিখ কিডনির সমস্যা নিয়ে তাঁকে শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। 


দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।  সেই কারণেই ৭১ বছর বয়সের অভিনেত্রীর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর।


টানা ২৫ দিন সেখানে চিকিৎসারত ছিলেন তিনি। আজ বুধবার দুপুরে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।


 চলতি বছর ২২ মে ৭১-এ পা দিয়েছিলেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। 


মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো সেই কিংবদন্তির পথ চলা থমকে গেল বুধবার।


 চলে গেলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘বিমলা’।


ভারতীয় থিয়েটারে অভিনয়ে তার অবদানের জন্য তিনি সংগীত নাটক অকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন।


১৯৭০-এর শুরুর দিকে ইলাহাবাদে এ. সি. বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনার অধীনে স্বাতীলেখা থিয়েটারে কাজ শুরু করেন।


 তিনি বি. ভি. কারাট, তাপস সেন ও খালেদ চৌধুরীর মতো লোকের উৎসাহও পেয়েছেন। 


১৯৭৮ সালে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং নান্দীকর নাট্যদলে যোগদান করেন।


 নান্দীকরে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের নির্দেশনায় তিনি কাজ করতে থাকেন।


১৯৭৫ সালে সত্যজিৎ রায় নির্দেশিত ঘরে বাইরে ছবিতে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে তিনি মুখ্য নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। 


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরে উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে ছবিটি বানানো হয়েছিল।

সত্ত্বা -- শঙ্খ শুভ্র চক্রবর্তী

 সত্ত্বা

========

কলমে -- শঙ্খ শুভ্র চক্রবর্তী 


আমিও তাদেরই একজন 

আমার এ হৃদয় জুড়ে, 

তরঙ্গে তরঙ্গ  ছোটে, মেঘেতে লুকাইলো চাঁদ  l 

আমারো হৃদয় আছে, 

আজ আমি বড়ো একা, 

খুঁজেতেছি মোর পাশে কোনো  আপনজন  l 

হোক না  শত দূর  শত পর l 

কেউ তো  হবে মোর  খুবই আপন , 

আমিও তাদেরই  একজন l 

সে  আলোকের পাখি, 

আমি হয়তো  আঁধারে  থাকি 

কখনো  দেখি না এই আঁখির আলোক l

আমি তাদেরই একজন l 

তাকে ভালোবেসে, বিন্দু বিন্দু প্রাণ দিয়ে, 

নিজ জীবন্ত মৃতদেহ বাঁচায়ে দেখাবো  কি ভাবে  ? 

যা দেখিলে হয় না মরণ, আমি তাদেরই একজন l//

*************

চলে গেলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

 চলে গেলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

★★★★★★★★★★★★★★★



বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (জন্ম: ১৯৪৪ বয়স ৭৭) একজন ভারতীয় কবি এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতেও কবিতার ছোঁয়া বিদ্যমান ছিল।তার বিখ্যাত কয়েকটি ছবি হল বাঘ বাহাদুর, তাহাদের কথা,চরাচর ও উত্তরা। শ্রেষ্ঠ পাঁচটি চলচ্চিত্র বাঘ বাহাদুর (১৯৮৯)চরাচর (১৯৯৩), লাল দরজা (১৯৯৭), মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২) , কালপুরুষ (২০০৮), দূরত্ব (১৯৭৮)এর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, এবং তাহাদের কথা (১৯৯৩) বাংলাতে শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্মের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন। পরিচালক হিসেবে তিনি উত্তরা (২০০০) এবং স্বপনের দিন (২০০৫) এর জন্য দুইবার সেরা নির্দেশনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি গভীর আড়ালে, কফিন কিম্বা সুটকেস, হিমযুগ, ছাতা কাহিনি, রোবটের গান, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভোম্বোলের আশ্চর্য কাহিনি ও অন্যান্য কবিতা সহ কবিতার বিভিন্ন রচনা প্রকাশ করেছেন।


জন্ম

১১ ফেব্রুয়ারি১৯৪৪

আনারা,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত


কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

জন্ম ও শিক্ষাজীবন 

তিনি ১৯৪৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ পুরুলিয়ার নিকটবর্তী আনারাতে একটি বৈদিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, এবং নয় জন ভাইবোন ছিলেন। তার বাবা তারাকান্ত দাশগুপ্ত ভারতীয় রেলওয়ের একজন ডাক্তার ছিলেন, এইভাবে তিনি শৈশবের প্রথম অংশ অতিবাহিত করেছিলেন। বারো বছর বয়সে তিনি হাওড়া দিনবন্ধু স্কুলে পড়াশোনা করার জন্য কলকাতায় যান। স্বাধীনতার পর তার পিতা প্রথমে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর এবং মানেন্দ্রগড় (এখন ছত্তিশগড়ে) বদলি হন । 


তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি অধ্যয়ন করেন।


কর্মজীবন 

বুদ্ধদেব অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্যামসুন্দর কলেজে এবং কলকাতার সিটি কলেজের পাশে। ১৯৭৬ সালে যখন  তিনি অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, যা তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য গ্রহণ করেছিলেন।  এদিকে, কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে তার সদস্যপদ, যেখানে তিনি প্রথম তার কাকার সাথে সিনিয়র হাই স্কুলে থাকা অবস্থা‌য় যাচ্ছিলেন,তা তাকে চার্লি চ্যাপলিন, ইঙ্গমার বার্গম্যান, আকিরা কুরোসাওয়া, ভিত্তরিও দে সিকা, রবার্টো রোসেলিনি এবং মাইকেল এনজেলো আন্তোনিওনির মত পরিচালকের কাজের সাথে পরিচয় করিয়েছিল । যা পরবর্তীতে, তাকে অভিব্যক্তির একটি পদ্ধতি হিসাবে ফিল্ম তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে।  তিনি ১৯৬৮ সালে ১০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি দ্য় কন্তিনেন্ত অব লাভ দিয়ে চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন,অবশেষে তিনি ১৯৭৮ সালে তার প্রথম সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্ম, দূরত্ব তৈরি করেছিলেন।


তার গীতসংহিতাও চলচ্চিত্রের সাথে বর্ধিত হয়। তার চলচ্চিত্রের কর্মজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে, দাশগুপ্ত সত্যজিৎ রায়ের বাস্তবসম্মত চলচ্চিত্রগুলির দ্বারা অনুপ্রাণিত চলচ্চিত্রগুলি তৈরি করেছিলেন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য রূপে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বাঘ বাহাদুর, তাহাদের কথা, চরাচর ও উত্তরা হল তার বেশিরভাগ প্রশংসিত চলচ্চিত্র।


চলচ্চিত্রপঞ্জি 

ফিচার ফিল্ম 

সময়ের কাছে (১৯৬৮) (short)

দুরত্ব (১৯৭৮) (Distance)

নিম অন্নপূর্ণা (১৯৭৯) (Bitter Morsel)

গৃহযুদ্ধ (১৯৮২) (The Civil War)

অন্ধ গলি (১৯৮৪) (Blind Alley)

ফেরা (১৯৮৮) (The Return)

বাঘ বাহাদুর (১৯৮৯) (The Tiger Man)

তাহাদের কথা (১৯৯২) (Their Story)

চরাচর (১৯৯৩) (Shelter of the Wings)

লাল দরজা (১৯৯৭) (The Red Door)

উত্তরা (২০০০) (The Wrestlers)

মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২) (A Tale of a Naughty Girl)

স্বপ্নের দিন (২০০৪) (Chased by Dreams)

আমি, ইয়াসিন আর আমার মধুবালা (২০০৭) (The Voyeurs)

কালপুরুষ (২০০৮) (Memories in the Mist)

জানালা (২০০৯) (The Window)

মুক্তি(২০১২)

পত্রলেখা (২০১২)

আনোয়ার কা আজিব কিসসা (২০১৩) (Sniffer, Hindi)

টোপ (২০১৭)

তথ্যচিত্র ও টিভিকর্ম 

দ্য় কন্তিনেন্ত অব লাভ (১৯৬৮)

ঢোলের রাজা ক্ষিরোদ নট্য (১৯৭৩)

ফিশারম্যান অব সুন্দরবন (১৯৭৪)

সারাচন্দ্র (১৯৭৫)

রিদম অব ষ্টিল(১৯৮১)

ইন্ডিয়ান সায়েন্স মার্চেস অ্যাহেড (১৯৮৪)

বিজ্ঞান ও তার আবিষ্কার (১৯৮০)

গ্লাস স্টোরি (১৯৮৫)

ভারত অন দ্য মুভ (১৯৮৫)

সিরামিকস (১৯৮৬)

আরণ্যক (১৯৯৬)

কন টেম্পোরারি ইন্ডিয়ান স্ক্‌লাপচার (১৯৮৭)

হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান জুট(১৯৯০)

পুরস্কার ও সম্মাননা 

২০০৮ সালের ২৭ মে স্পেনের মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে জীবনকালের কৃতিত্বের সম্মাননা প্রদান করা হয়। 

২০০৭ সালে এথেন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন এথেনা পুরস্কার

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

সেরা চলচ্চিত্র

১৯৮৯: বাঘ বাহাদুর

১৯৯৩: চরাচর

১৯৯৭: লাল দরজা

২০০২: মন্দ মেয়ের উপাখ্যান

২০০৮: কালপুরুষ

সেরা নির্দেশনা

২০০০: উত্তরা

২০০৫: স্ব‌প্‌নের দিন

সেরা চিত্রনাট্য

১৯৮৭: ফেরা

বাংলাতে সেরা ফিচার ফিল্ম

১৯৭৮: দূরত্ব

১৯৮৭: ফেরা

১৯৯৩: তাহাদের কথা

শ্রেষ্ঠ আর্টস / সাংস্কৃতিক ফিল্ম

১৯৯৮: এল পেইন্টার অফ ইলোকেন্ট সাইলেন্স: গণেশ পাইন

ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল

১৯৮২: এফআইপিআরএসসিআই পুরস্কার: গৃহযুদ্ধ

২০০০: শ্রেষ্ঠ পরিচালক জন্য সিলভার লায়ন: উত্তরা

১৯৮২: গোল্ডেন লায়ন মনোনয়ন: গৃহযুদ্ধ

২০০০: গোল্ডেন লায়ন মনোনয়ন: উত্তরা

বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

১৯৮৮: গোল্ডেন বিয়ার মনোনয়ন: ফেরা

১৯৯৪: গোল্ডেন বিয়ার মনোনয়ন: চরাচর 

লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভাল

সমালোচকদের পুরস্কার: দূরত্ব

বিশেষ জুরি পুরস্কার: নিম অন্নপূর্ণা

এশিয়া প্যাসিফিক চলচ্চিত্র উৎসব

সেরা চলচ্চিত্র: জানালা

কার্লোভি ভারি ফিল্ম ফেস্টিভাল

বিশেষ জুরি পুরস্কার: নিম অন্নপূর্ণা

দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

গোল্ডেন প্রাইজ: নিম অন্নপূর্ণা

ব্যাংকক আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভাল

সেরা এশিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড (২০০৩): মন্দ মেয়ের উপাখ্যান

পরিবার 

তার বড় কন্যা, অলকানন্দা দাশগুপ্ত, একজন প্রশিক্ষিত শাস্ত্রীয় পিয়ানোবাদী, তার ২০১৩ সালের চলচ্চিত্র, আনোয়ার কা আজিব কিসসার জন্য পটভূমি স্কোর রচনা করেছিলেন।

শহীদ বিধায়ক অজিত সরকার এবং মাধবী সরকারের তিরোধান দিবস পালন

  বিহার বাঙালি সমিতি পূর্ণিয়া শাখা  দুজন মহান শহীদ বিধায়ক অজিত সরকার এবং  মাধবী সরকারের তিরোধান দিবস মিঠুন দাসের নেতৃত্বে কেশব দাস, হরি দাস ,গৌরব দাস , নারায়ণ চন্দ্র দাস,শংকর দাস, দেবরাজ দত্ত ,সজল দাস, রবি দাস এবং প্রসেনজিৎ দাস এর  দ্বারা অজিত সরকারের প্রতিমায় পুষ্প অর্পণ করে তিরোধান দিবস পালন করা হয়।

বিহার বাঙালি সমিতি বার বার বাঙালি হিসেবে ওনাদের কাছে সহযোগিতা করার জন্য গিয়েছিল। যথা সম্ভব সহযোগিতা সমিতি তাদের থেকে পেয়েছে। 







প্রতিবেদন - নারায়ণ চন্দ্র দাস

'নজরুল স্মরণে' ~ড. আশিস্ কুমার সিংহ

'নজরুল স্মরণে'

  ~ড. আশিস্ কুমার সিংহ


পঞ্চম পর্ব       

  


নজরুল নিজের ব্যক্তিত্ব গঠন সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, "আগুন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃ‌ষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা -- এই অষ্টধাতু নিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্ছে, যা হবে দুর্ভেদ্য, মৃত্যুঞ্জয়, অবিনাশী।" এই কারণেই সময় ও সমাজ - সচেতন কবি লিখলেন, "আমরা এক‌ই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু - মুসলমান।" 


নজরুলের সাহিত্য - সৃষ্টির কালকে পন্ডিতজনেরা এক কথায় বাঙালির নিত্যকার জীবনে ও মানসে সঙ্ঘাত ও অস্থিরতার কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দেখা যাবে যে তখন সেই একদিকে যেমন  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জনিত ক্ষয় - ক্ষতি -- অবক্ষয় আর বিপর্যয়, সেই সঙ্গে আবার রাশিয়ার বিপ্লবের সাফল্য আর তার সঙ্গে এলো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিজেদের লক্ষ্য পথে এগিয়ে যাবার অদম্য জিদ। অন্য দিকে আবার বাংলা কংগ্রেসের গুটি - গুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়া, মুসলিম লীগের ক্রমশঃ শক্তিশালী হ‌ওয়া, সেই সঙ্গে সাম্যবাদের শুধু দানা বাঁধা‌ই নয় ক্রমশঃ শক্তিবৃদ্ধির দিকটাও জমাট বাঁধলো। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, আবার আগস্ট আন্দোলনের পদধ্বনিও ক্রমশঃ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠা আর সাম্প্রদায়িকতার ক্রমশঃ এগিয়ে যাওয়া -- এই সমস্ত ঘটনারাজি বাঙালির জীবনে এবং মনে একটা বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। এই কারণেই নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে এই সমস্ত ভাব - ভাবনার একটা স্বাভাবিক প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া লক্ষণীয় যে তৎকালে নজরুল‌ই আমাদের মাঝের একমাত্র প্রথম শ্রেণীর কবি  বা উপন্যাসকার যিনি কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। রুশ বিপ্লব ও সাম্যবাদে আপাদমস্তক প্রভাবিত কারাগার নির্যাতিত কবি লিখলেন, "নাহি - দেশ - কাল - পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে সব কালে, ঘরে - ঘরে, তিনি মানুষের জ্ঞাতি।" আবার ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণনগরে  বঙ্গীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী আসরে 'কান্ডারী হুঁশিয়ার' - এর রচয়িতা, মূল গায়ক ও সুরকার নজরুল লিখলেন, "হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কান্ডারী -- বলো, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র।" এখানে কবির শুভ বুদ্ধি কেবল নয়, প্রাসঙ্গিকতার দিকটিও যথারীতি লক্ষণীয়। তিনি বেদনার্ত হৃদয়ে দেখছেন, "গঙ্গা আছে, পদ্মা আছে -- কাবেরী আছে ও কৃষ্ণা আছে, কিন্তু সে মানুষ তো নেই।" এই কারণেই ১৮৯৯ সালের আমাদের সেই কবি আজকের এই ২০২১ - এতেও একেবারে নতুন -- এই কারণে তাঁর রচনায় প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছু নেই।


 শ্যামা সঙ্গীত রচনায় তিনি যতটা নিষ্ঠাবান ও একাগ্র, 'শাতিল আরব', আর 'মোহররমে'-ও তিনি ততটাই নিষ্ঠাবান ও একাগ্র। এই প্রসঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন,"নজরুল সেই বিরল অসামান্যদের একজন যাদের ঠিক একটা ছাপা চেহারায় চেনা যায় না। আমরা মূক বিস্ময়ে লক্ষ্য করবো যে "ঝড় হুল্লোড়ের সেনাপতি" যিনি একদিন ইংরেজ রাজপ্রাসাদের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, 'টর্পেডোর' - র সর্বনাশা ঝড়ে যখন রাজতন্ত্রের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম তখন সেই ১৯৪১ সালের ৫-৬ এপ্রিল কোলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতি হিসেবে নিজের জীবনের শেষ অভিভাষণে নজরুল বলেছিলেন, "আমাকে কেবল মুসলমান বলে দেখবেন না, আমি যদি আসি, আসবো হিন্দু - মুসলমান সকল জাতির ঊর্ধ্বে।" যিনি এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর দাস হয়ে, আমৃত্যু এই অন্তিম আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে নিয়ে জনসাধারণের কবি যিনি সৃষ্টির ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতা নিয়ে আমাদের মাঝে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, সেই কবির ওপার বাংলার ঢাকায় ২৯-এ আগষ্ট,  ১৯৭৬- এ দেহাবশান ঘটে। 


নজরুল নিঃসন্দেহে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন কিন্তু অধার্মিক ছিলেন না। তিনি হিন্দুদের পক্ষে কিংবা মুসলমানদের পক্ষে বলার জন্য নয়, তিনি সর্বত্রব্যাপী আলোর মতো মানুষের কথা বলার জন্য সাহিত্য আসরে অবতরিত হয়েছিলেন। চিরন্তন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত সত্য ধর্মে আস্থাশীল নজরুল সমস্ত শোষিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে লেখনী ধারণ করে , হতবাক হয়ে ভগবানের কাছে 'ফরিয়াদ' করেছেন, "জনগণে যারা জোঁক সম শোষে, তারে মহাজন কয় -- সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়। 

মাটীতে যাঁদের ঠেকেনা চরণ, মাটীর মালিক তাঁরাই হন -- যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ, সেই তত বলবান।" পরিশেষে 'আমার কৈফিয়ৎ'-এ কবির কৈফিয়ৎটুকু জানিয়ে আমি আমার এই লেখা শেষ করছি। কবি লিখেছেন,"রক্ত ঝরাতে পারিনাতো একা, তাই লিখে যাই এ রক্ত - লেখা।..... প্রার্থনা ক'রো -- যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।" নজরুল সেই রক্ত লেখার কবি।


অন্তিমে সমস্ত দিক পর্যালোচনা করে ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমরাও নজরুলকে বলতে পারি, "তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহৎ।"


'নজরুল - প্রণাম - পর্ব' - এবারের মতো এখানেই শেষ করলাম।


'গ্রন্থ - ঋণ' -

১. সঞ্চিতা - নজরুল ইসলাম

২. সাহিত্য - সঙ্গ - আবদুল       

     আজীজ আল - আমান

৩. নজরুল স্মৃতি - সম্পাদক :

     বিশ্বনাথ দে

৪. আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয় -  

     ড. দীপ্তি ত্রিপাঠী

৫. জ্যৈষ্ঠের ঝড় - অচিন্ত্য কুমার  

     সেনগুপ্ত

৬. নজরুল কাব্যগীতি : বৈচিত্র্য ও   

     মূল্যায়ন - ড. বাঁধন সেনগুপ্ত

৭. বিহার বাঙ্গলা অকাডেমি 

     পত্রিকা : নজরুল সংখ্যা 

'নজরুল স্মরণে' ~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ

 'নজরুল স্মরণে'

~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ


চতুর্থ পর্ব



নজরুলের‌ও আগে আমাদের সাহিত্যে বিদ্রোহের সুর ক্রমশঃ উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়ে উঠছিল। ‌১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর সোচ্চার আবির্ভাবের আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, স্বভাব কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস, ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, দেহবাদী কবি মোহিতলাল মজুমদার ও অতুল প্রসাদ সেনের কবিতায় আগে থেকেই বিদ্রোহের সুর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। অন্য দিকে আবার পরাধীন ভারত - সন্তানের মনে দেশপ্রেমের ভাব জাগরিত করার জন্য গিরীশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রমুখদের নাটকে ইংরেজ - বিরোধিতার সুর আর এই পরিপ্রেক্ষিতে 'বন্দে মাতরম'- এর সম্পাদক ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, 'যুগান্তরে'- র সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং 'সন্ধ্যা' পত্রিকার সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রমুখদের রচনায় দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বিদ্রোহভাব ক্রমশঃ জমাট বাঁধছিল। এখন সত্যের খাতিরে আমাদের স্বীকার করেই নিতে হবে যে তৎকালীন এই ব্যক্তিত্বেরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নজরুল -  সাহিত্যকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিলেন। এই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলেও প্রধানতঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আমাদের কবির বহু আগেই সাহিত্যে মেহনতী জনগণের কথা আর সেই সঙ্গে বলিষ্ঠ সাম্যবাদকে একটি শক্তিশালী ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। সমাজের নিপীড়িত ও অবহেলিত জনসাধারণের বেদনা - জর্জরিত নিত্যকার নানা জীবনের কথা এঁদের লেখনীর মাধ্যমে বলিষ্ঠ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এমনকি যে তীব্র যৌবন - আবেগ নজরুলের কবিতাকে একটি বিশেষ স্বীকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তার প্রথম প্রকাশ নিঃসন্দেহে সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যেই লক্ষ্য করা গেছে। এই কারণে গবেষকেরা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকেই নজরুলের একমাত্র সার্থক পূর্ব- সূরী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে এটা অনস্বীকার্য যে সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যে সমকালীন সমাজ ও কালচেতনা শুধুমাত্র যেখানে ইশারা বা ইঙ্গিতের মাধ্যমে আমাদের মাঝে একটা অশান্ত স্ফূলিঙ্গের মতো দেখা দিয়ে উড়ে গেছে, সেখানে কালসচেতনতা ও তৎকালীন সমাজে ব্যাপ্ত অনিয়ম আর উচ্ছৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নজরুলের কাব্যে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ও জীবন্ত। যথার্থতা হলো এই যে নির্যাতিত ও নিপীড়িতদের প্রতি বেদনায় কবি আকন্ঠ ডুবে থাকায় তাঁর বিদ্রোহ স্বাভাবিক কারণেই স্বীয় কাব্যে অধিকতর সোচ্চার হয়ে উঠেছে।


নজরুল প্রথম থেকেই বিদ্রোহী, "আমি শ্রাবণ - প্লাবন - বন্যা, কভু - ধরণী - রে, করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস - বন্যা -- আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু - বক্ষ হ‌ইতে যুগল কন্যা।" তিনি চির বিদ্রোহী বীর। সৃষ্টি - সুখের - উল্লাসে কবি এগিয়ে চলেছেন সাম্যের গান গাইতে - গাইতে। "গাহি সাম্যের গান -- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা - ব্যবধান, যেখানে মিশিছে হিন্দু - বৌদ্ধ - মুসলিম - ক্রীশ্চান। গাহি সাম্যের গান।" 


নজরুল নতুনকে পুরোনোর জায়গায় মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এগিয়ে চলেছেন আর সেই সময় দেশবাসীকে বীর্যের ক্ষেত্রে সত্যের সন্ধানে এগিয়ে এসে নতুন সৃষ্টির জন্য সরবে ডাক দিয়েছেন তিনি অকম্পিত চিত্তে। বস্তুতঃ পক্ষে নজরুলের ব্যক্তিত্ব ও কবিত্ব মিলে একাকার হয়ে যাওয়ায় কবিতায় ও গানে উদ্দাম - উচ্ছাস আর বিদ্রোহ ও উদ্দীপনাকে কাব্য রূপ দেওয়ার সঙ্গে - সঙ্গে তাঁর চিত্তে সনাতন পন্থীদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের অভিযোগ, যেগুলি এতদিন ধূমায়িত অবস্থায় ছিল, সেগুলি কাব্য রূপ লাভ করে। লক্ষণীয় যে এক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া - কালে আমাদের কবি কোন ধরণের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর জাতিভেদকে সামান্যতম প্রশ্রয় না দিয়ে  তৎকালীন  সমাজে প্রচলিত 'বাদের' উর্ধ্বে উঠে তিনি চার দিকের অনিয়ম আর সমস্ত বাঁধন আর নিয়ম - কানুন আর শৃঙ্খলকে দুর্বার বেগে ভেঙ্গে চুরমার করতে - করতে বিশ্ব - বিধাত্রীর বিদ্রোহী - সুত নজরুল এগিয়ে চলেছেন -- মনে - প্রাণে তখন তিনি একজন যথার্থ স্বদেশী - নির্ভেজাল একজন। সমাজের চতুর্দিকে ব্যাপ্ত  মনুষ্যত্বের অবহেলা ও মানবিকতার অবমাননায় বিব্রত কবি কালক্ষেপ না করে নিজের অগ্নিবর্ষী লেখনীর মাধ্যমে মানুষের জয়গানে চতুর্দিকে তুফান তুলেছিলেন। "সাম্যের গান গাই! -- যত পাপী - তাপী সব মোর বোন, সব‌ হয় মোর ভাই। এ পাপ মুলুকে পাপ করেনিক' কে আছে পুরুষ - নারী? আমরা তো ছার; -- পাপে পঙ্কিল পাপীদের কান্ডারী।.. হেথা সবে সমপাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়া অন্যের পাপ মাপি।"


শুধু গান আর কবিতাই নয়, নিজের আলোড়নকারী মানসিকতাকে আরো বেশি দুর্দম করার তাগিদে নজরুল 'ধুমকেতু' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল আচার - অনুষ্ঠানের বেড়াজাল ভেঙ্গে নতুন চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণের প্রাচুর্য লক্ষ্য করে তিনি সমাজ - স্থিত অন্যায় - 

অবিচারের স্বরূপ উদঘাটন কল্পে প্রকাশিত এই পত্রিকা, রাজশক্তির ভিত্তিতে আঘাত করে। শাসক বর্গ সচকিত হয় এবং আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করবো যে 'ধুমকেতু' সন্ত্রাসবাদে প্রেরণা জোগাচ্ছে, এই মিথ্যা অভিযোগে পত্রিকাটিকে বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং কবি কারারুদ্ধ হন। বলাই বাহুল্য, এর পরের এগারো মাসের কারাগারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, আমাদের কবিকে আরো বেশি ক্ষিপ্ত ও ক্ষিপ্র করে তুলেছিল।

রক্তদান শিবিরের পুরস্কার : বিহার বাঙালি সমিতি, ভাগলপুর শাখা

 আজ JLNMCH,BHAGALPUR (blood bank) এর তরফ থেকে  বিহার বাঙালি সমিতি কে 2020 সালে শহরে একটি রক্তদান শিবিরে সব থেকে বেশি রক্তদান করাবার জন্য প্রথম পুরস্কার আর দ্বিতীয় পুরস্কার এক বছরের সব থেকে বেশি রক্তদান করাবার জন্য দেওয়া হয়। এর সাথে আমাদের দুই সদস্য শ্রী উত্তম দেবনাথ ও শ্রী নিরুপম কান্তি পাল কে মোটিভেশন কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হয়। যা আমাদের জন্য খুব  গর্বের বিষয়। সমিতি গত ৮বছর থেকে সব থেকে বড় রক্তদান শিবিরের পুরস্কার গ্রহণ করে আসছে। এই পুরস্কারের জন্য আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন । আপনাদের সহযোগিতা না পেলে সম্ভব হত না।












জয়জিৎ ঘোষ, সম্পাদক, বিহার বাঙালি সমিতি, ভাগলপুর শাখা

'নজরুল স্মরণে' ~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ

 'নজরুল স্মরণে'

~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ


তৃতীয় পর্ব


আমাদের মধ্যেকার জাতিভেদ প্রথা কবিকে মুহূর্তের জন্যেও স্বস্তি দেয়নি। এক্ষেত্রে একদিকে তিনি যেমন ব্যঙ্গ - বিদ্রূপের তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করতে কালক্ষেপ করেননি অন্য দিকে তেমনই মুসলমানদের ধর্ম - গৌরবকে অবলম্বন করে তিনি বহু বিদ্রোহমূলক কবিতাও লিখেছেন। আসল কথা হলো এই যে আমাদের কবির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মানুষ বসবে মানুষের আসনে, মানুষকে অসম্মান করে, অগ্রাহ্য করে কোন ধর্ম‌ই কখনো বড় হতে পারে না, বড় হয় না। কেন না, মানুষের জন্য‌ই ধর্ম এসেছে, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। "মানুষ এনেছে ‌ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোন।" আত্মপ্রত্যয়ী কবি নজরুল গুরুগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করেছিলেন, "মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্।" ঠিক এক‌ই কারণে নারী জাতিকে পুরুষ জাতির সমকক্ষীয় বলে মনে না করা, দূরে সরিয়ে রাখা আর নানাবিধ শাস্ত্রীয় গালভরা কথার জালে জড়িয়ে তাকে অগ্রাহ্য করাকেও কবি সর্বদা ঘৃণার চোখে দেখেছেন। উদাত্ত স্বরে বলেছিলেন, "সাম্যের গান গাই -- আমার চক্ষে পুরুষ - রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।



বিশ্বে যা - কিছু মহান্ সৃষ্টি চির - কল্যাণকর, অর্দ্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী, অর্দ্ধেক তার নর।" আবার সমাজে সর্বক্ষেত্রে নিন্দিত  বারাঙ্গনাকে মাতৃ সম্বোধন করে তার অন্তরস্থিত নারীত্ব এবং মাতৃত্বের প্রতি সম্মান দেখাতে তিনি কখনোই দ্বিধান্বিত হন নি। কবি লিখেছিলেন, "কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা, মা, কে দেয় থুতু ও - গায়ে?

হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতাসম সতী মায়ে।"

তিনি আরো বলেছিলেন, "অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তান ও তবে জারজ সুনিশ্চয়।"


ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও সাহিত্য -- সর্বত্র‌ই তিনি মানুষকে জাতি - ধর্ম - বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানবিকতার আদর্শে পূর্ণরূপে প্রকাশিত দেখতে চেয়েছিলেন। এই কারণে যেখানে নজরুল এগুলির দেখা পাননি, সেখানেই আমরা তাঁর বিদ্রোহকে রীতিমত জীবন্ত অবস্থায় পাই আর লক্ষ্যণীয় যে এর সঙ্গে প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়শীলতা একীভূত হ‌ওয়ার ফলে কবি দ্বিধাহীন কণ্ঠে কিছুটা বাধ্য হয়েই বলেছিলেন, "আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।" 


প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা এবং ধর্ম‌ ব্যবস্থার বিরোধিতা করাকে আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক বলে মনে হলেও এমন‌ মতবাদের পিছনে দর্শন - সমর্থিত কোন যুক্তি কিন্তু নেই। এছাড়া, ঈশ্বরকে অস্বীকার করার কোন উদ্দেশ্য, আমাদের কবির কোথাও দেখা যায়নি বরং ঈশ্বরকে  স্বীকার করে চিরন্তন সত্যকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করার একটা অন্তরঙ্গ প্রচেষ্টা আমরা নজরুলের 'বিদ্রোহবাদে' লক্ষ্য করে থাকি। কোন দুরন্ত শিশুর মায়ের উপর যখন রাশিকৃত অভিমান থাকে, মাকে তখন সে অগ্রাহ্য করে। এটাই তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এই ধরণের অস্বীকৃতি মাঝে - মধ্যে দেখা গেলেও সেটি কিন্তু মায়ের প্রতি সন্তানের অভিমান ছাড়া যেমন অন্য কোন কিছু হতে পারে না, ঠিক তেমনি আমাদের কবির ঈশ্বরকে ক্ষণিক অস্বীকার করাটা কখনোই কবির ঈশ্বরের উপস্থিতিকে পূর্ণতঃ অগ্রাহ্য করার দ্যোতক নয়, সেটি ঈশ্বরের প্রতি আমাদের কবির অভিমান মাত্র। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই এই সত্যটি আমাদের মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই ধারণাকে কোন ক্রমেই কবির 'নাস্তিকতা' বলে মনে করা যায় না। অন্য দিকে, চিরন্তন সত্যকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, পাশবিক শক্তিকে প্রতিহত করার ক্ষমতা লাভের জন্য আমরা আমাদের কবিকে ঈশ্বরের কাছে শক্তি ভিক্ষাও করতে দেখি। এই কারণে আমরা কবির বিদ্রোহবাদকে নাস্তিক্যবাদ না বলে  যথার্থ আস্তিক্যবোধক‌ই বলবো। এর একমাত্র কারণ হলো, প্রবল ঔচিত্যবোধ থেকেই নজরুলের কাব্যে বিদ্রোহ একটি ব্যতিক্রমী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।  তাঁর বিদ্রোহের মূলে রয়েছে মানুষের প্রতি অপরিমিত শ্রদ্ধাবোধ। এই কারণেই তাঁর রচনায় বিদ্রোহ, নিছক বিদ্রোহ নয়, মানবিকতার জয়গানে সজীব হয়ে বিদ্রোহ এখানে আমাদের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। 


কখনো - কখনো, আমাদের মনে হয়েছে যে তাঁর বিদ্রোহ, শুধুমাত্র তৎকালীন ইংরেজ - সরকারের বর্বরতাকে কেন্দ্র করেই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই ধারণাটি নিঃসন্দেহে পূর্ণতঃ পক্ষপাত দুষ্ট। থিতিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে শুধুমাত্র ইংরেজ সরকারের অন্যায় - অবিচারকে কেন্দ্র করে কবির 'বিদ্রোহভাব' আবর্তিত হয়নি বরং আমাদের ভারতভূমিতে তৎকালে বহুল প্রচলিত ধর্ম - ব্যবস্থায়, সমাজ - ব্যবস্থায় আর সাহিত্যের সুবিশাল ক্ষেত্রে বহুধা প্রচলিত নানা ধরণের গোঁজা - মিল, জোড়া - তালি, গড়া - পেটা, অনাচার, অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলতা - আমাদের কবি যেখানে‌ই লক্ষ্য করেছিলেন, তাঁর বাঁধনহারা কণ্ঠ সেখানেই গর্জন করে উঠেছিল। কবি বলেছিলেন, "যেথায় মিথ্যা ভন্ডামি ভাই, করবো সেথায় বিদ্রোহ। ধামা - ধরা ! জামা - ধরা! মরণ - ভীতু! চুপ্ রহো।" অর্থাৎ আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করবো যে কবির বিদ্রোহ কোন দিক থেকেই একমুখিন নয়, বহুমুখিনতা নিয়ে আজ‌ও আমাদের সাহিত্য জগতে এক এবং অদ্বিতীয় হয়ে আছে।


প্রয়াত কমল দাস

 "শোক  সংবাদ "

          মুজঃফরপুর

এই সমাজে তোমার স্মৃতি 

                 আজও অম্লান,

অনেক কীর্তি  বাড়ায়েছে

                  আমাদের মান

আকস্মিক বজ্রপাতের মতই নিদারুণ ভাবে আমাদের বাঙ্গালী  সমাজকে আঘাত করল শ্রী কমল দাসের (পুচকি) মৃত্যু (২৮-৫-২০২১)।



আমরা মূহ‍্যমান। আমরা বিহ্বল। আমরা শোকস্তব্ধ। শ্রী কমল দাসের আকস্মিক ও অকাল প্রয়াণ অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। আমাদের শ্রী কমল পালাপার্বনে,সভা সমিতিতে ও বিভিন্ন সামাজিক কাজে সবসময় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকতেন। হরিসভা দুর্গাপূজো সমিতি ও বীণাকনসার্ট ক্লাবের সাথে ওতপ্রোতভাবে লীন হয়ে যাওয়া সম্পর্ক অত‍্যন্ত মাধুয‍্যপূর্ণ ও ঘটনাবহুল।

       ১৯৭২ সালে "শিশুভারতী সংস্থার"হয়ে "স্ফুলিঙ্গ"ও মুকুট নাটকে অভিনয় করেছিলেন। মুকুট নাটকটি মুজঃফরপুর ও পাটনায় রবীন্দ্রভবনে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল।

    আমাদের কাছে এই আকস্মিক শোক ব‍্যক্ত করার মত কোন ভাষাই যথেষ্ট নয়। আমরা তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সীমাহীন সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাচ্ছি ও ঈশ্বরের কাছে আমাদের এই প্রার্থনা যে পরলোকে তাঁর বিদেহী আত্মা পরম শান্তি লাভ করুক।

প্রতিবেদন - শুভাশীষ বোস

বর্ণপরিচয়