সতীনাথ ভাদুড়ী: জন্মদিনে কিছু কথা

সতীনাথ ভাদুড়ী:  জন্মদিনে কিছু কথা

বিহারে একই শহরে থাকা আমাদের। একই পাড়ায়। বহু বছর আগে তখন অপরিণত মন তাই বুঝতে পারিনি মানুষটির মহীরূহ উচ্চতা। তাঁর মননশীলতা ও বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ত্বের অতলান্তি গভীরতা মাপার ক্ষমতা হয়নি তখন। এখন কি হয়েছে তা ?

শুধু সময়ের নিয়ম মেনে শরীরের বয়েস হওয়া। তবু যেহেতু একই জায়গার মানুষ তাই এই সাহস বা লেখার ইচ্ছেটুকু।

ফনীশ্বর নাথ রেণু লিখেছেন মারে গএ গুলফাম। আমরা জানি তিসরী কসম সিনেমা সেই কাহিনীর চিত্ররূপ।

উনি ছোটবেলায় আসতেন বাবার সঙ্গে সতীনাথের বাড়িতে। লক্ষ্য করছিলেন সতীনাথের বাবার সততা, মূল্যবোধ। পরবর্তী সময়ে রেণু যখন সেন্ট্রাল জেল, ভাগলপুরে ভাদুড়ীজীর সঙ্গে রাজনৈতিক বন্দী। তিনি দেখলেন সতীনাথের চরিত্রও বাবার মত সততা মূল্যবোধ জাড়িত। রেণুজীর ভাদুড়ীজী। সম্পর্কটি শ্রদ্ধার ও ভালবাসার। কত বিষয়ে জানার আগ্রহ সতীনাথের। পূর্ণিয়ার এই মানুষটির বিহারের এই শহরটির প্রতি এক আশ্চর্য্য টান। আজন্ম তাই এখানেই থাকা। পূর্ণিয়াতে থেকেই সাহিত্য সৃজন। গতানুগতিক পথধরে লেখা নয়। এক নতুন আঙ্গিকে নিজেকেই অতিক্রম করে যাওয়া। তাই শ্রদ্ধেয় মুজতবা আলী বলেছেন Writers writer. লেখকের লেখক হয়ে ওঠা পূর্ণিয়া শহরের মিতভাষী সৌম্য দর্শন মানুষটির। পূর্ণিয়ার মাটির আন্চলিক রূপকার কি যত্নের সঙ্গে রচনায় নিয়ে এলেন স্থানীয় চরিত্র ঢোঁড়াই, বদরা মুচিদের। তাঁর অতি নিবিষ্ট পর্য্যবেক্ষণে পূর্ণিয়া ও তার আশেপাশের অন্চল খুঁজে পেল লেখকের হাত ধরে সাহিত্যের অনির্বচনীয় পৃষ্ঠভূমি। মরেঙ্গা হয়ে গেল মরগামা। তাঁর বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের তাতমাটোলার ঠাকুরবাড়ি হয়ে গেল মিলিট্টি ঠাকুরবাড়ি। আমাদের পাশের শহর কাটিহার তাঁর লেখায় মাটিহার আর তাঁর নিজের প্রিয় বিচরণ ভূমি পূর্ণিয়া হয়ে গেল জিরানিয়া।

সুধী একটা প্রশ্ন তৈরী হয়। সাহিত্যের নতুন ইতিহাসের নির্মাণ কি এরকম ভাবেই হয়? পর্য্যবেক্ষণের নিবিষ্টতায়, মননশীলতার গভীরতায় মিশে যায় লেখকের অন্দরমহল অনুভূতি। হাতের তালুর মতন সতীনাথের চেনা আমাদের শহর ও বিহারের গ্রাম্যজীবন। পরিশ্রমী অভিজ্ঞতা।একটার পর একটা গ্রামের ভেতরে যাওয়া। সেখানকার মাটি কাদা খড়ের চালের নীচে বসত করা গ্রাম্যজীবন ও মানুষজনের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে মেলামেশা। এ সমস্ত উপাদানের সঙ্গে যোগ হয়েছে সতীনাথের মেধা, অন্য জাতের চেতনা। তাঁর বিস্তৃত বহুস্তরীয় অধ্যয়ন, প্রকৃতি রহস্যের অপার জিজ্ঞাসা, বৈজ্ঞানিক কৌতূহল।

কোন লেখাটির কথা বলব? কোনটির উল্লেখ করব না ? বড় জটিল এই বেছে নেওয়া। একটি উপন্যাসের বিষয় ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিকায় আলো ফেলে। প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার সম্মানে আলোড়ন ফেলে পাঠক সমাজে, বুদ্ধিজীবী সমালোচক মহলে।

সকলেই জানেন জাগরীর কথা বলছি। নতুন মাইল স্টোন গাঁথা হয়ে যায়। আবার যদি বলি ঢোঁড়াই চরিত মানস। তাঁর এই  উপন্যাসের মেজাজ অন্যরকম। এখানে মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি আঁকা হয় নি।আঙ্গিকের অভিনবত্ব, তাতমাটুলির কাহিনী, ঢোঁড়াই, বুধনী, বৌকা বাওয়ার আখ্যান কখন যেন কালোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে।

আমার ক্ষমতার বাইরে ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক সতীনাথের অসাধারণ সাহিত্য ও বহুমুখী জীবনধারা কাজের সঠিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। তাঁর রচনা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে প্রথম শ্রেণীর পত্র পত্রিকায়। দেশ, অমৃত, পরিচয়, আনন্দবাজার পত্রিকা ও অন্যান্য সাহিত্য পত্রে।

পূর্ণিয়ার সুবল গাঙ্গুলি সম্পাদিত সতীনাথ স্মরণে, আলো রায়ের এই পরবাস, আফিফ ফুয়াদের সম্পাদনায় দিবারাত্রির কাব্য উল্লেখযোগ্য কাজ সতীনাথ সার্বিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে।

বিনম্রতার সঙ্গে বলি আমার ঠাকুমার নাম রত্নময়ী দেবী। সতীনাথ আসতেন আমাদের বাড়িতে। দিদির কাছে ভাইফোঁটা নিতে। ঠাকুমার খুড়তুত ভাই সতীনাথ ভাদুড়ী। আমাদের বাড়ির বারান্দায় নিয়মিত বিকেলবেলায় আসতেন সতীনাথ সহপাঠী ও ফুটবলার সুধীর চ্যাটার্জি (নীলু দাদু)। গল্প আড্ডা হত কৃপানাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে। কৃপানাথ সতীনাথের সতীর্থ ও খুড়তুত ভাই। তিনি আমার দাদু। আজকের বিশেষ দিনটিতে আবেগ তাড়িত তাই হয়ত ব্যাক্তিগত স্মৃতিচারণা।

আমাদের পূর্ণিয়া শহরের একটি নান্দনিক শিল্প সংস্কৃতি, খেলাধূলো ফুটবল এ্যাথেলেটিক্স পরম্পরার গৌরবোজ্জল ইতিহাস রয়েছে। পুরোধা ব্যাক্তিত্বরা রয়েছেন। সেই নক্ষত্রমণ্ডলে সতীনাথের অবস্থান আমাদের প্রাণিত করে। যেন আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শহরের স্বর্ণিম ঐতিহ্যকে নিয়ে যেতে পারি অন্য উচ্চতায়। ২৭ শে সেপ্টেম্বর ২০২০। তাঁর জন্মদিনে আজ এই অঙ্গীকার হোক তাঁর প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।

অপরাজেয় কথাশিল্পীকে জানাই বিনম্র প্রণাম।

অজয় সান্যাল

বিহার বাঙালি সমিতি, পূর্ণিয়া শাখা।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান: বিহার বাঙ্গালী সমিতির বরারী শাখা

 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান

বিহার বাঙ্গালী সমিতির বরারী শাখা

 







২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৫.০০টায় বিহার বাঙ্গালী সমিতির বরারী শাখা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান পালন করে। অনুষ্ঠানে শাখা সদস্য, নিঃশুল্ক বিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রীরা ও কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথি সহ কেন্দ্রীয় সহ সচিব শ্রী তাপস ঘোষ মহাশয় উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সচিব তাপস ঘোষ এবং নিঃশুল্ক বিদ্যালয় শিক্ষিকা সবিতা রাজবংশি দ্বারা দ্বীপ প্রজ্বলন করা হয়। বিশিষ্ট অতিথি শ্রী দীপক মন্ডল (রংমহোৎসব উদ্যোক্তা), শাখা সচিব শ্রী দুলাল কিশোর সরকার ও শাখা সভাপতি শ্রী তরুণ ঘোষ যৌথ রূপে বিদ্যাসাগরের চিত্রে মাল্যদান করেন। সকল সদস্য এবং উপস্থিত বিশিষ্ট জন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চিত্রে পূষ্প শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। অনেকে বিদ্যাসাগরের বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যাসাগর রচিত কবিতা আবৃত্তি করে। অনুষ্ঠান পরিচালনা ক্রমে শাখার তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ভাগলপুর শহরে বিদ্যাসাগরের প্রতিমা স্থাপন হওয়া উচিত। এই বিষয়ে শাখার সভাপতিকে DM মহাশয়কে অনুরোধ জানিয়ে আবেদন করতে বলা হয়। সভাপতি মহাশয় দ্বায়িত্ব নিয়ে দুই-একদিনের মধ্যে আবেদন করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অনুষ্ঠানে অশোক চন্দ্র সরকার, অসীম কুমার পাল, হরে রাম রাজবংশি, সুব্রত মালাকার, সুনিতা, প্রিয়াঙ্কা, শোভনা, সুভশ্রী, গৌরী, গৌরব, সৌরভ বিশেষ রূপে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে বহু আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত হতে না পারায় ফোনে দুঃখ প্রকাশ করেন।

তরুণ ঘোষ, বরারী শাখা

অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাই বিদ্যাসাগর দ্বিশতবার্ষিক জন্ম জয়ন্তীর উষ্ম অভিনন্দন। বিদ্যাসাগর বাঙ্গালীর সম্বল। তাঁকে স্মরণ করার সৌভাগ্য লাভ করে নিজেদের জীবন ধন্য মনে করছি।

খুব খুশির বিষয়, ভাগলপুরে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যাসাগর দ্বিশতবার্ষিক জন্ম জয়ন্তী উদযাপন করা হয়। দুর্গা চরণ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক গণ ও বাঙ্গালী শিক্ষিত বর্গের বিশিষ্ট জন সম্মিলিত রুপে বিদ্যাসাগর দ্বিশতবার্ষিক জন্ম জয়ন্তী পালন করেন। সমিতির বরারী শাখার শাখা-সদস্য গণ, সমিতির নিঃশুল্ক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র ছাত্রীরা এবং বেশ কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথির উপস্থিতিতে বিদ্যাসাগর দ্বিশতবার্ষিক জন্ম জয়ন্তী পালন করেন। বক্তারা তাঁর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। ছাত্র ছাত্রীরা কবিতা আবৃত্তি করে। ভীষণ বৃষ্টিতেও অনুষ্ঠানে নজর কাড়ানো উপস্থিতি দেখা গেছে। এইরূপ অনুষ্ঠান আয়োজন অক্ষুণ্ণ অব্যাহত থাকলে জাতীর সাংস্কৃতি সবল হতে থাকবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি। ধন্যবাদ ।

তাপস ঘোষ, জোন - ২, ভাগলপুর 

দ্বিশত জন্মবর্ষে স্মরণ : সজল গুহ

 দ্বিশত জন্মবর্ষে স্মরণ

বিধবা বিবাহের প্রবর্তক বিদ্যাসাগর তুমি,

দ্বিশত জন্মবর্ষে তোমার চরণ চুমি।

অশিক্ষা,কু সন্সকার থেকে করেছিলে সমাজ মুক্ত,

রানী রাসমণি ও অন্তরা করেছিল তোমার হাত শক্ত।

অন্যায়ের কাছে নোয়াওনি কখনো মাথা,

কীর্তি তোমার রয়েছে ইতিহাসে গাঁথা।

দিয়েছো এনে সমাজে অনেক সন্মান,

অকৃতজ্ঞ মোরা, তোমায় কেবলি করি অপমান।

----- ধন্যবাদ সহ সজল কুমার গুহ শিলিগুড়ি।

ফিরে দেখাছ : কর্মাটাড়ে

 

ফিরে দেখা

গতবছর পন্ডিত মহাশয়ের দ্বিশতজন্মদিনে তাঁর শেষ জীবনের (১৮৭৩-৯১) কর্মস্থল কর্মাটাড়ে আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা সংস্কৃতি সমিতি শিলিগুড়ি শাখার তরফে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত শিক্ষারত্ন প্রহ্লাদ বিশ্বাস, অনিল সাহা ও আমি। প্রকাশিত হয় সমিতির একটি ছোট্ট ক্রোড়পত্র ও উত্তরের প্রয়াস সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ বিদ্যাসাগর সংখ্যা।


বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু বিদ্যাসাগর অনুরাগীর সমাগম ঘটে। এক দারুণ অনুভূতি অনুভব করি। মনে হয়েছিল যেন পন্ডিত মহাশয় আজো বিরাজমান সেখানে।

তাঁর ব্যবহৃত খাট, বাড়ী, কুয়া সেই গাছ।

প্রতিবেদন – সজল গুহ

"বিদ্যাসাগর সন্ধানে": তথ্যচিত্র: রাজ ব্যানার্জী

 "বিদ্যাসাগর সন্ধানে"

 





আজ (২৬.০৯.২০২০) বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী পূর্তির দিনে আমার তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ছিল আমার নবনির্মিত তথ্যচিত্র "বিদ্যাসাগর সন্ধানে" এর প্রদর্শন। আজ দুপুর ৩.০০ টের সময় শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের প্রাঙ্গণে, বিদ্যাসাগরের স্বহস্তে রোপিত কার্মাটাড়ের হিমসাগর আম গাছের চারা, যা উক্ত বিদ্যালয়ে অত্যন্ত যত্ন সহকারে পরিচর্যিত হচ্ছে সেই রোকেয়া স্মৃতি তরুতে এবং ভাগলপুর প্রেরিত আমীর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি তরুমূলে পুষ্পার্ঘ্য প্রদানের মাধ্যমে এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী অনুষ্ঠানের সূচনা করেন বিদ্যালয়ের প্রধানা শিক্ষিকা পাপিয়া নাগ। এরপর উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী সম্প্রীতি চৌধুরী। স্বাগত ভাষণ দেন পাপিয়া নাগ। এরপর আমার তৈরি তথ্যচিত্রটি প্রদর্শিত হয়। উপস্থিত ছিলেন প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শক্তি মন্ডল, রণজিত্ মন্ডল, বিমান বসু, কমলেন্দু ধর, ডাক্তার শংকর কুমার নাথ, ডাক্তার মমতাজ সংঘমিতা, হেমেন্দুবিকাশ চৌধুরী, কৃতিশ্বর ভৌমিক, সুস্বাগত বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুশ্রী চৌধুরী, শতাব্দী দাস, প্রমুখ বিদগ্ধ গুণীজন। জাতীয় সংগীতের পর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়।

প্রতিবেদন – রাজ ব্যানার্জী, ফেসবুক পেজ

বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান: 'নিউ গড়িয়া গণতান্ত্রিক বাইশে আগস্ট কমিটি ২০০৪'

 বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান

নিউ গড়িয়া সমবায় আবাসনের আবাসিকদের সংগঠন 'নিউ গড়িয়া গণতান্ত্রিক বাইশে আগস্ট কমিটি ২০০৪' বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। নবীন প্রজন্মের আবাসিকরা যাতে বিদ্যাসাগর চর্চায় আগ্রহী হন, তাই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। নবীন প্রজন্মের আবাসিকদের তিনটি বিভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল। প্রথম বিভাগটি ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত, দ্বিতীয় বিভাগটি ১৬+ থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত, এবং তৃতীয় বিভাগটি ২৫+ থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত। প্রতি বিভাগে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল, এবং বিদ্যাসাগরকে নিয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক রচনা লিখতে হয়েছিল।



বিভাগ-'ক'।। প্রথম- ঈশান চ্যাটার্জী।।


বিভাগ-'ক'।। দ্বিতীয়- সমৃদ্ধি দেবনাথ।।



বিভাগ-'ক'।। তৃতীয়- অরিত্র মুখোপাধ্যায়।।

 

বিভাগ-'খ'।। প্রথম- সৌমিলি ভট্টাচার্য্য।।

বিভাগ-'খ'।। দ্বিতীয়- রোহন সেন।।

বিভাগ-'খ'।। দ্বিতীয়- অনন্যা মহাপাত্র।।

বিভাগ-'গ/ক'।। প্রথম- জয়শ্রী মৈত্র।।


অতিমারী পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতা  ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে করা সম্ভব নয় বলে, প্রশ্নপত্র বাড়িতে দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে  বিদ্যাসাগর-চর্চার মাধ্যমে নবীন প্রজন্ম নতুনভাবে বিদ্যাসাগরকে চিনবেন, এটাই আশা ছিল।


 
                                  বিভাগ-'গ/ক'।। দ্বিতীয়- সায়ন্তনী বিশাল।।
বিভাগ-'গ/ক'।। দ্বিতীয়- দেবাঙ্গনা ঘোষাল।।


                                 
বিভাগ-'গ/ক'।। তৃতীয়- সুচেতা রায়।।


এই উদ্যোগে প্রশ্নপত্র তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন ড. শুভঙ্কর চক্রবর্তী (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য), ড. পবিত্র সরকার (রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য), শ্রী আশীষ লাহিড়ী (বিদ্যাসাগর গবেষক), শ্রী অমলেশ দাশগুপ্ত (এশিয়াটিক সোসাইটি সংশ্লিষ্ট), ড. অরুণাভ মিশ্র (অধ্যাপক, বিদ্যাসাগর কলেজ), শ্রী অমিত দাস (রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও আবাসিক) ও শ্রী সমীর কুমার চক্রবর্তী। এঁদের কাছে কমিটি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
বিভাগ-'গ/ক'।। তৃতীয়- শায়রী চৌধুরী (বেঙ্গালুরুবাসী) পক্ষে বোন সৃজনী।।

অতিমারীর কারণে প্রশ্নপত্র বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন কমিটির সদস্যরা। উত্তরপত্রও সেভাবেই সংগৃহীত হয়েছিল। বিভাগ তে ২৪ জন প্রতিযোগী, বিভাগ তে ৩৩ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিভাগকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। বিভাগ গ"-এ, এবং বিভাগ ”-বি। এই দুই বিভাগে যথাক্রমে ২৯ এবং ৩২জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশিষ্ট আবাসিকরা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে সক্রিয় সহায়তা দান করেছেন। বিশেষ উল্লেখের বিষয় এই যে, ১১৮ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ৭৮ জন মহিলা, যা বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা প্রয়াসের জ্বলন্ত উদাহরণ।

বিভাগ-'গ/খ'।। দ্বিতীয়- অভিষেক সরকার।।

বিভাগ-'গ/খ'।। প্রথম- রত্নাশ্রী দেব।।


আজ, ২৬শে সেপ্টেম্বর, বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে অতিমারী বিধি মেনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সফল প্রতিযোগীরা তাঁদের শংসাপত্র গ্রহণ করেন এবং প্রতি বিভাগের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারীরা তাদের পুরস্কার গ্রহণ করেন। এই উপলক্ষ্যে বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য একটি ভিডিও কোলাজ নির্মিত হয়েছে যার বিষয় ভাবনা শ্রী অমিত দাস মহাশয়ের, কারিগরী ভাবনা নবীন প্রজন্মের এবং সামগ্রিক নির্মাণের দায়িত্বে আবাসনের পরিচালন সমিতির সদস্যা ড. ঝর্ণা রায়। কমিটির সকলের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনুষ্ঠানটি সাফল্যমন্ডিত হয়, তবে আহ্বায়ক ড. সত্যরঞ্জন বিশাল তাঁর সক্রিয় ভূমিকার জন্য বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখেন। 'নিউ গড়িয়া গণতান্ত্রিক বাইশে আগস্ট কমিটি ২০০৪' এর সভাপতি ডাঃ কমল কৃষ্ণ মাইতি ও সম্পাদক ড. অম্বিকেশ মহাপাত্র সমগ্র অনুষ্ঠানটির সুচারু সম্পাদনার কারিগর।

বিভাগ-'গ/খ'।। তৃতীয়- রুম্পা ব্যানার্জী।।

বাঙালি মনীষার মধ্যে বিদ্যাসাগর তত চর্চিত নন। এইরকম অনুষ্ঠান সেই অচর্চিত ধূলার আস্তরণ সরিয়ে বিদ্যাসাগরের চরিত্র আবার দীপ্যমান করে তুলবে, এই আশা রাখি।

প্রতিবেদন – ডঃ অম্বিকেশ মহাপাত্র





ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্ম জয়ন্তী

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্ম জয়ন্তী







গতকাল (২৬.০৯.২০২০) রাজনারায়ণ বসু বাংলা পাঠাগারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০ বছর জন্ম জয়ন্তী পালন করা হয় এবং এই উপলক্ষ্যে আয়োজিত প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

প্রতিবেদন – পার্থ মুখার্জী, সম্পাদক, রাজ নারাণয় বসু পাঠাগার

মীরা চৌধুরী প্রয়াত

 মীরা চৌধুরী প্রয়াত

 


গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাই আমাদের ফরবেশগঞ শাখার, বিহার বাঙ্গালী সমিতির সহ-সভাপতি শ্রী উজ্জ্বল চৌধুরীর মা আমাদের মাসীমা (মীরা চৌধুরী) গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ সকাল ৯ ঘটিকায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। ওঁনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

   শোকাহত পরিবার ও পরিজনদের জানাই সমবেদনা।

প্রতিবেদন – প্রণব কুমার দাস

এই সংবাদ সময়মত পাঠিয়েছিলেন। দেরী করে পোস্ট করার জন্য দুঃখিত।

সুনির্মল দাশ, সম্পাদক, সঞ্চিতাবল্গ

কার্মাটারে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিস্থল পরিদর্শন

 কার্মাটারে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিস্থল পরিদর্শন


পশ্চিমবঙ্গের, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বেলদা ও কেশিয়াড়ি এলাকার ৬ বিদ্যাসাগর অনুরাগী সোমবার কার্মাটারে বিদ্যাসাগর এর স্মৃতিস্থল পরিদর্শন করলেন। ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন পূর্বতন অবিভক্ত মেদিনীপুর, বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম। সেই জেলার মানুষ হিসেবে আমরা গর্বিত। এদিন পরিদর্শকদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও সাংবাদিক অখিলবন্ধু মহাপাত্র। তিনি বলেন কার্মাটারে নন্দনকানন বাঙালির কাছে এক গর্বের নজির। মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক বিদ্যাসাগরকে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। সাঁওতাল বিদ্রোহ উত্তর সময়ে উপেক্ষিত আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিদ্যাসাগরের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা প্রয়োজন। চালু করা উচিৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া বালিকা বিদ্যালয়টি। এক্ষেত্রে ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় সরকারের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। তবে ভারতীয় রেল মানবতাবাদী ননবজাগরণের মূর্ত প্রতীক বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত স্টেশনের সৌন্দর্যায়নের ব্যবস্থা করায় আমরা আনন্দিত।


 

পশ্চিম মেদিনীপুর এর জনপ্রিয় লোক কবি পরেশ বেরা বলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যবহৃত ঘরে ঢুকতেই শিহরিত হলাম। নন্দনকানন এর ভিতরের অংশ আরও সুসজ্জিত হলে ভালো হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কিছু পুরানো ছবি এবং তাঁর সম্বন্ধীয় গ্রন্থাবলী রাখা প্রয়োজন।

জেলার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও স্বরলিপি সঙ্গীত একাডেমীর সাম্মানিক অধ্যক্ষ প্রদীপকুমার মাইতি বলেন, অনেক দিনের একটি স্বপ্ন আজ পূরণ হল। কার্মাটারের এই মাটিকে প্রণাম জানাই।

এদিনের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য শিক্ষক ফটিক বেরা বলেন কার্মাটারের এই মাটিতে বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা অত্যন্ত জরুরি।

এছাড়াও লেখক ও সমাজকর্মী মলয় কুমার দাস এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক বিশ্বসিন্ধু দে কার্মাটাড়ের এই মাটিতে আরও রক্ষণাবেক্ষণ এবং সৌন্দর্য্যায়নের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। সকলেরই বক্তব্য কার্মাটাড়ের এই এলাকায় পৌঁছানোর জন্য জামতাড়া থেকে রাস্তায় উপযুক্ত দিক নির্দেশিকা বোর্ড লাগানো প্রয়োজন। এদিন এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ছিলেন কার্মাটারের নন্দন কাননের কেয়ারটেকার জীতেন্দ্র মণ্ডল। শুধু কার্মাটারের নন্দনকানন নয়, বিদ্যাসাগর স্টেশনটিও ঘুরে দেখেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।

প্রতিবেদক - গৌতম চট্টোপাধ্যায় , দুমকা

বিদ্যাসাগর পথ, কর্মাটাঁড় - বিদ্যুৎ পাল

 প্রথম দৃশ্য

 

[সকাল। একটা বারান্দাওয়ালা পুরোনো বাড়ির একাংশ বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে। সামনে কয়েকটি ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। একজন একটু এগিয়ে এসে সেলফোনে কথা বলছে। “হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চিন্ত থাকুন। আমাদের টীমের সবাই এসে গেছে। আপনার মন্ত্রী টন্ত্রী আসার আগে সব কিছু রেডি থাকবে। হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর দ্বিশতবার্ষিকীর ব্যানার তৈরি আছে, প্রতিমার আবরণ, ফেস্টুন, বৃক্ষরোপণের জন্য দশ বারোটা চারা... যে ক’টা আপনারা ডিগনিটারিজরা পুঁতবেন পুঁতবেন, বাকিগুলো আমরা পুঁতে ফেলব।  ... এ্যাঁ, এখন? আমরা রিহার্সালটা দিয়ে রাখছি একবার। এরপর আর সময় পাবো না। রাখছি ফোনটা। মন্ত্রীর গাড়ী বেরুলেই আমাকে ফোন করে দেবেন। ফোনটা রাখে।]

ছেলেটি -       হ্যাঁ, একনম্বর প্ল্যাকার্ডটা দে। কার কাছে আছে। (একজন এগিয়ে দেয়। ছেলেটি বাড়ির সামনে প্ল্যাকার্ডটা গেঁথে দেয়। লেখা আছে ‘নন্দন কানন, কর্মাটাঁড়’। স্টার্ট! মোড়ল, চাষী, চাষীবৌ, শাস্ত্রীমশাই, সতীশ... (আঙুল দেখিয়ে এক এক করে সম্বোধন করে।) সবাই নিজেদের পার্টগুলোয় আছো?... চলো। (বলে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। একটি ছেলে শুধু বাড়ির ভিতরে ঢোকে। বেরিয়ে আসে ঈষৎ মেক-আপ, ধুতি আর ফতুয়া চড়িয়ে। ... বাড়ির সামনের বারান্দায় ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পায়চারী করছেন। সামনে টেবিলের ওপর একতাড়া কাগজপত্র রাখা আছে। মোড়ল প্রবেশ করে।)

মোড়ল -        পেন্নাম, দেওতা! সে তো আবার কাহিল হয়ে পড়েছে রে! ...ওই যে বুড়ি, যাকে ওষুধ দিয়ে এলি না তুই গতকাল!

ঈশ্বর-           জ্বর কতো?

মোড়ল -        তা তো জানি না। ওর পড়শি বলছিল, একা একা ঘরে কোঁকাচ্ছে ভোর থেকে। তোকেই যেতে হবে আরেকবার, দেওতা।

ঈশ্বর-           তখন থেকে আমাকে দেওতা দেওতা করছিস কেন বল তো?

মোড়ল -        বাঃ, তুই তো দেওতাই। সবাই তো তোকে ঈশ্বর-দেওতা বলে আশে পাশের সবক’টা গাঁয়ে!

ইশ্বর -          বটে। আমি দেওতা। যেমন তুই মোড়ল।

মোড়ল -        (জিভ কাটে, কান ধরে) না, না। ছি। কী বলছিস। আমি কি সত্যি মোড়ল নাকি? গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরি, দশ ঘরের খবরাখবর নিই, হালচাল পুছি ... লোকে তো দুয়োও দেয় যে আমি নাকি একের কথা অন্যকে বলে ঝগড়া লাগাই, পাকামি করি ... মোড়লিপানা করি তাই মোড়ল বলে ঠাট্টা করে লোকে।

ঈশ্বর    -       তা আমাকেও ওই ধরণের দেওতা বানাতে...

সাঁওতাল -     (প্রবেশ করে; চাদরের খুঁট খুলে ছয়-সাতটা ভুট্টা বার করে) ও বিদ্যেসাগর, আজ আর আমার বাজারে গিয়ে এ ক’টা          বিক্রি করা হবে না। তুই রাখ, পাঁচ গন্ডা পয়সা দে আমায়।

ঈশ্বর    -       দাঁড়া, (মোড়লকে) দ্যাখ, কী বলল আমায়! বিদ্যেসাগর।

মোড়ল -       (সাঁওতালকে, বিদ্যাসাগরকে দেখিয়ে) এ্যাই, ও কে রে?

সাঁওতাল -     (হাঁপাতে হাঁপাতে, ঈষৎ কেশে) বিদ্যেসাগর (কপালে হাত ঠেকিয়ে) দেওতা, দেওতা আমাদের!

ইশ্বর     -       (এগিয়ে এসে মাটিতে ঝুঁকে সাঁওতালের হাতটা টেনে নিয়েছিলেন, নাড়ি দেখছিলেন) তোর তো

                   জ্বর রয়েছে ভালো রকম। একদাগ ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাক আজকের দিনটা।

                   পাঁচ গন্ডা পয়সাও দিচ্ছি।

মোড়ল -       দেখলি... (বিদ্যাসাগরের চোখের দিকে চেয়ে চুপ করে যায়)

ইশ্বর     -       তুই যা, আমি বুড়িকে দেখে আসবো একটু বেলায়। (ভিতরে চলে যান ওষুধ আনতে, ফিরে

                   আসেন, সাঁওতালকে ওষুধ খাওয়ান) যা, ঘরে গিয়ে একটু আরাম কর সারা দিন। জ্বরটা ছেড়ে যাওয়া উচিৎ। না ছাড়লে কাউকে দিয়ে খবর পাঠাবি। আর, এই নে পয়সা (সাঁওতাল চলে যায়)। (মোড়লের দিকে তাকিয়ে) কী রে, তুই গেলি না? আচ্ছা, যাস নি যখন, একটা কাজ করে দিয়ে যা। বারান্দার ওধারে দেখ্‌ এক গোছা শুকনো ডালপালা রাখা আছে। ঘরের ভিতরে মেঝেতে দড়ি আছে আর তাকে ছুরিও আছে। সব নিয়ে যা আর আমার নতুন আমচারাটার চারদিকে একটা বেড়া করে দে তো। কচি পাতা বেরোচ্ছে নিচের দিকে – গরু, ছাগল ঢুকে খেয়ে যেতে পারে। ... পারবি তো?

মোড়ল -       (উঠতে উঠতে) এটা কোনো কাজ? আমাকে দু’একটা ওষুধপত্তর শিখিয়ে দিতিস, আমিও একটু চিকিচ্ছে করতাম মাঝে মধ্যে।

ঈশ্বর    -       (অট্টহাসি হেসে ওঠেন) ওঃ হো হো, এই জন্যে তুই বার বার আসিস এখানে! তা তুই তো জ্বরই বুঝতে পারিস না নাড়ি দেখে! দুটো ওষুধের নাম শিখেই গাঁয়ের কোবরেজকে টক্কর দিবি? ... তখন সত্যি তোকে লোকে ঠেঙিয়ে গাঁছাড়া করবে। আর আমাকেও করবে তোকে শিখিয়েছি বলে। (ঈষৎ গম্ভীর হয়ে) লোকের ভালো করতে চাস ভালো কথা। সেবাশুশ্রুষা কর। পায়ে তেল লাগিয়ে দেওয়া, মাথা ধুইয়ে দেওয়া ... এগুলোও তো অনেক আরাম করে দেয় রুগীর। আর একটু লেখাপড়া শেখ! তুই তো আমার বড়দের স্কুলটাতেও আসিস না নিয়মিত। ওই যখন তখন চেহারা দেখিয়ে যাস।

মোড়ল -       (বারান্দার ওধারে, কাঠের টুকরোগুলো বাছতে বাছতে) লজ্জা করে। সবাই পেছনে লাগে। ... এই

                   ডালগুলো তো জবর! একদম সোজা সোজা তিন হাত। কোত্থেকে পেলি?

ঈশ্বর    -       গাঁয়ে গাঁয়ে যাই তো রুগী দেখতে। ফেরার সময় জঙ্গল থেকে বেছে কুড়িয়ে জড়ো করেছি।

 

[মোড়ল ডালগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে কাঁধের ওপর ফেলে। বাকি দড়ির গোছা আর ছুরিটা নিয়ে চলে যায় আমগাছের দিকে। বিদ্যাসাগর, সাঁওতালের রেখে যাওয়া ভুট্টাগুলো নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢোকেন।]   

 

 

দ্বিতীয় দৃশ্য

 

[দুপুর বেলা। প্রথম ছেলেটি ঢুকে বাড়ির সামনের প্ল্যাকার্ডটা পাল্টে করে দেয় ‘গেরস্থ ঘর’। আরেকটি ছেলে উঁকি মারে নেপথ্য থেকে।]

 

দ্বিতীয় ছে-      শুধু একটা প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে দিলে হবে? নন্দন কাননের বাড়িটা পাকা। আর এ গেরস্ত ঘর খড়ের ছাউনি, ওপরে লাউমাচা, দাওয়া আর উঠোনটা মাটির...

প্রথম ছে        -         অতশত মঞ্চসজ্জা নিয়ে হবে এই ছোট্টো নাটক? তাও থিয়েটারের স্টেজ হবে না, নেতাদের ভাষণের মঞ্চ হবে। আর পরে যদি করতেও হয় তো পথনাটিকার ধরণে করবো। তখন তো (বাড়ির অংশটাকে ইংগিত করে) এটুকুও পাবো না।

 

[ছেলেটি আর কথা না বাড়িয়ে একটা বড় চটের ছালা ভিতর থেকে টানতে টানতে এনে ছুঁড়ে ফেলে বাড়ির ছাতের ওপর। তারপর টেনে নামিয়ে ঢেকে দেয় ছাতটা। প্রথম জন হেসে ওঠে, “এটা কী হল? আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার চল!” দুজনেই বেরিয়ে যায়। ... বিদ্যাসাগর গাঁয়ের পথ ধরে ভিনগাঁ থেকে ফিরছেন। ঘরের দাওয়া থেকে পথের প্রান্ত অব্দি ছোট্টো জায়গাটায় একফালি বেগুনের খেত। বিদ্যাসাগর বসে পড়লেন। ভিতর থেকে এক বৌ পড়ি মরি করে দৌড়ে এল।]

 বৌ       -       এ্যাই, কে, কে ওখানে? বেগুন চুরি করার মতলব? ওঠ! ওঠ বলছি। (বিদ্যাসাগর উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে বৌটি এক হাত ঘোমটা মাথার ওপর টেনে জিভ কাটলেন।) ইশ্বর-দেওতা! আমি চিনতে পারিনি। ক্ষমা করবেন।

ঈশ্বর    -       (তখনও বেগুনের দিকে তাকিয়ে) তোমরা এই প্রথম বেগুন ফলালে, না আগেও লাগিয়েছ?

বৌ       -       প্রথম। আপনি একটু বসুন না দাওয়ায়, আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। এই তো পিছনেই, আতা গাছটা কাটছে। ফল হয় না। (বলে দৌড়ে চলে যায় পিছনে, এবার দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে)।

চাষী     -       আপনি এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে। একটু বসবেন না বিদ্যেসাগর? আমার বৌ বুঝতে পারে নি আপনি বসে আছেন ওখানে। ওর দোষ নেবেন না। একটু বসুন এসে। না এলে আমরা অপরাধী হয়ে থাকবো।

ঈশ্বর    -       আমি কিছু মনে করিনি গো। ভরদুপুরে অজানা কেউ খেতের ওপর ঝুঁকে থাকলে তো সন্দেহ হতেই পারে। আচ্ছা চল, দাওয়ায় গিয়ে বসি। (বলে নিজেই গিয়ে কিনারে বসে পড়েন)।

চাষী     -       আ হা হা, ধুলোতে বসলেন কেন? (বৌকে) একটা আসন নিয়ে আয় না শীগগিরই! (বৌ ভিতরে চলে যায়)।

ঈশ্বর    -       লাগবে না। পরিষ্কার আছে জায়গাটা। যা বলছিলাম শোনো। বেগুনগুলো এ কেমন ধারা হয়েছে? ছোট্টো, কোঁকড়ানো, তাও প্রতিটা চারায় একটা দুটো করে? বেগুন তো এ মাটিতে ভালো হওয়া উচিৎ।

বৌ       -       (ততক্ষণে আসন নিয়ে এসে আসন হাতে দাঁড়িয়ে আছে পিছনে) সেই তো। আমি তো বলেছিলাম, আমাদের গ্রামে কত ভালো বেগুন হয়। আপনি এই আসনটায় বসুন দেওতা। (বিদ্যাসাগর উঠে দাঁড়ালে বৌটি আসন পেতে দেয়। বিদ্যাসাগর আবার বসে পড়েন)।

চাষী     -       যা বীজ পেলাম জামতাড়ার বাজারে তাই তো এনে লাগালাম। কেন এমন হল! আপনি একটু সরবত খাবেন বিদ্যেসাগর? দূর থেকে আসছেন, ক্লান্ত হয়ে। আমরা ছোটো জাত নই দেওতা, বৈশ্য। (বিদ্যাসাগর চোখ উঠিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে তাকান আর আসন ছেড়ে উঠে পড়েন) না, না, ঘাট হয়েছে, মানে, আমরা জানি আপনি জাতপাত মানেন না, কিন্তু... সরবতটুকু খেয়ে যাওয়ার...

ঈশ্বর    -       (হেসে ফেলেন) সরবত নয়, জল দাও এক ঘটি। সেটাও খাবো না কিন্তু, আগেই বলে দিচ্ছি। না,

                   কোনো রাগে টাগে নয়। কড়া রোদ্দুর তো। আর এতটা পথ যেতে হবে এখন। এখন পেটে জল গেলে ক্ষতি হবে। তবে হ্যাঁ, ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে শরীরটা চাঙ্গা করে নিই। যাও মা, একটু জল এনে দাও। অন্য কোনোদিন তোমার হাতের সরবত খেয়ে যাবো, ঠিক আছে?

                   (বৌটি জল এনে দিলে বিদ্যাসাগর খেতের দিকে সরে এসে ঘাড়ে মাথায় জল দেন, কুলকুচো করেন; ওদিকে বৌটি কিছু একটা ইশারা করে বরকে খোঁচাতে থাকে)

চাষী     -       ইয়ে, বৌ বলছিল ও কি আপনার টোলে আসতে পারে?

ঈশ্বর    -       (মুখে হাসি নিয়ে বিদ্যাসাগর ঘুরে তাকান; বৌটি হাত থেকে ঘটি নিয়ে একটা গামছা এগিয়ে দেয়) বাঃ, এতো উল্টো স্রোত বইছে!

চাষী     -       আজ্ঞে?

ইশ্বর     -       গেরস্থ ঘরের পুরূষমানুষেরা মেয়ে-বৌদের লেখাপড়া শেখাতে চায় না, পড়তে দিতে চায় না। তোমরা তো নতুন যুগের মানুষ গো! ক’পুরূষ ধরে আছো এ গাঁয়ে?

চাষী     -       আমার পূর্বপুরূষের ভিটে জামতাড়ার কাছে। সেখানে আমার দাদারা থাকে। আমি একটু জমি নিয়ে এখানে বসবাস শুরু করেছি দশ বছর হল।

বৌ       -       (নিজে থেকেই) দশ এখনো হয় নি। ন’বছর চলছে। আমার বাপের বাড়ি এখানেই, তবে অনেকটা উত্তরে। আমাদের গাঁ থেকে যতদূর মিহিজাম, ততদূর কর্মাটাঁড়।

ইশ্বর     -       তা, প্রশ্নটার মানে বুঝলাম না!

চাষী     -       মানে, ও তো বৌ, এক বাচ্চার মা। তা বাচ্চা মেয়েদের সাথে বসতে বেমানান লাগবে, আবার বড় বড় পুরূষমানুষদের সাথে...

ইশ্বর     -       লেখাপড়া না শেখাটাই সবচেয়ে বেশী বেমানান আজকের যুগে। ও মেয়েদের স্কুলে বসতে চায় তো দিব্যি বসবে, কিচ্ছু ভাবার দরকার নেই। আর ওর সময় সুবিধে যদি বড়দের স্কুলের সময় হয়, তাহলে ওর জন্য আলাদা জায়গা থাকবে পর্দা দেওয়া। আসবে, আসতে দেবে তুমি, এটাই বড় কথা। আসি এবার, অনেক বেলা হল। ও হ্যাঁ, এবার যখন কলকাতায় যাব, তোমার জন্য ভালো বেগুনের আর টমেটোর, দেখেছ টমেটো, বিলিতি বেগুন বলে অনেকে, তা সেই টমেটোরও ভালো বীজ নিয়ে আসব। এত খারাপ ফলন হবে কেন? (বিদ্যাসাগর বেরিয়ে যান)

বৌ       -       আশ্চর্য, তুমি একবার খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে না? দুপুর শেষ হতে চলল। নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি ওনার। এখানেই পুকুরে স্নান করে দুটো ভাত খেয়ে যেতেন! আমাদেরই পূণ্য হত।

চাষী     -       ভূল হয়ে গেল, (নেপথ্যের দিকে এগিয়ে) ইশ্বর-দেওতা!

বৌ       -       আঃ, এখন পিছন থেকে ডাকছে। রাখো। পরে একবার গিয়ে নেমন্তন্ন করে এসো। এখন নিজে আগে চানটা সেরে এস, আমি ভাত বাড়ছি। (চাষী একটা টাঙানো গামছা টেনে কাঁধে ফেলে পিছনে চলে যায়, বৌটি ভিতরে চলে যায়)।   

    

  তৃতীয় দৃশ্য

 

[প্রথম ছেলেটি ঢুকে বাড়ির সামনের প্ল্যাকার্ডটা পাল্টে করে দেয় ‘কর্মাটাঁড় রেলস্টেশন’। ছাতের ওপরকার ছালাটা টেনে নামিয়ে পিছনে ফেলে বেরিয়ে যায়। ...নন্দন কানন যাওয়ার রাস্তা। তরূণ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং তাঁর ভ্রমণসঙ্গী সতীশ বসু বেরিয়ে হেঁটে আসছেন।]

 

শাস্ত্রী    -       সতীশ,এই কর্মাটাঁড় স্টেশনের স্টেশনমাস্টারের নামটা পড়েছিলে বোর্ডে?

সতীশ   -       না, খেয়াল করিনি তো!

শাস্ত্রী    -       তুমি যাঁর কাছে যাচ্ছো, তাঁর বিষয়ে কথিত আছে যে ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে প্রথমবার কলকাতা আসার সম শুধু মাইলস্টোন দেখে দেখে ইংরেজী সংখ্যা পড়া শিখে ফেলেন। আর তুমি, একটা স্টেশনে নামলে, স্টেশনমাস্টারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় কোথায় থাকেন, স্টেশনমাস্টার ইংরেজও নয়, বাঙালী, তার নামটাও পড়ে নিতে চাইলে না?

সতীশ   -       ওই জন্যেই তো! প্ল্যাটফর্মে এক মিনিট দাঁড়াতেও ইচ্ছে হল না।

শাস্ত্রী    -       মানে?

সতীশ   -       আমি তো আর বুঝিনি উনি বাঙালি না মারাঠি, তাই ইংরেজীতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি কি জানেন, বাংলার বিখ্যাত মানুষ, বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত ইশ্বরচন্দ্র শর্মা এখানে কোথায় থাকেন।

শাস্ত্রী    -       তারপর?

সতীশ   -       মুখটা বেঁকিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ইয়েস স্যার, উই আর ব্লেস্‌ড দ্যাট দ্য গ্রেট ম্যান লিভস হিয়ার। বুঝে গেলাম উনিও বাঙালি। জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, বাঙালি, তবে বিখ্যাত তো নই যে আমার জন্য স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম উঁচু করে দেবে সরকার বাহাদুর! আপনারা যান, ওই বিখ্যাত মানুষটার কাছে যান। স্টেশনের বাইরে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করুন, দেখিয়ে দেবে। তারপর যাহোক, আমাদের মালপত্রগুলো রাখার ব্যবস্থার কথা বললাম, একদিন পর আবার ট্রেন ধরব

                   লখনউ যাওয়ার, বললাম, তো করে দিলেন।

শাস্ত্রী     -      আশ্চর্য তো, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের পায়ে কষ্ট আছে বলে সরকার কর্মাটাঁড়ের প্ল্যাটফর্ম উঁচু করিয়ে দিয়েছে। সবাই জানে ব্যাপারটা। বিদ্যাসাগর একজনই আছেন সারা দেশে। তাঁর জন্য সরকার করতেই পারেন। তাতে স্টেশনমাস্টারের কিসে কষ্ট?  

সতীশ   -       জায়গাটা বেশ শান্ত আর নিরিবিলি, না?

শাস্ত্রী    -       হুঁ, কিন্তু রুক্ষ, পাহাড়ি! লাল মাটির দেশ।

সতীশ   -       তবে এই রাস্তাটা বেশ ছায়া ছায়া। কী বিরাট গাছগুলো দেখ! অনেক বয়স হবে। ...শুনেছি মনের কষ্টে এখানে এসে থাকছেন বিদ্যাসাগর মশাই।

শাস্ত্রী    -       আরে দূর, ইশ্বরদাদা হিমালয়। মনোকষ্ট, সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাওয়া, এসব ওনার ধাতে নেই। পায়ে বড় চোট পেলেন না? পেটটাও ভালো থাকেনা। ডাক্তাররা তো কবে থেকেই বলছিল হাওয়াবদল করতে। ... এটা ঠিক যে নারায়ণের ব্যবহারে দাদা কষ্ট পেয়েছেন। ... তুমি আবার এসব প্রসঙ্গ ওনার সামনে তুলোনা! (একটা বিরাট বটগাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন, তার বিরাটত্বের দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকান) দেখেছো, কী বিশাল! কত বয়স হবে বলো তো!

                                                দেব-অবতার ভাবি বন্দে যে তোমারে

                                                নাহি চাহে মনঃ মোর তাহে নিন্দা করি,

                                                তরুরাজ! প্রত্যক্ষতঃ ভারত-সংসারে,

                                                বিধির করূণা তুমি তরু-রূপ ধরি!

                                                জীবকূল-হিতৈষিণী, ছায়া-সুসুন্দরী,

                                                ...

                                                দেব নহ; কিন্তু গুণে দেবতার মত।

 

সতীশ   -       বাঃ! কার লেখা?

শাস্ত্রী    -       মাইকেল মধুসুদন দত্ত। পড়েছ?

সতীশ   -       বাবার আলমারীতে আছে। মেঘনাদবধ কাব্য। কিন্তু ভীষণ শক্ত।

শাস্ত্রী    -       এটা চতুর্দশপদী। এই মানুষটাকে কত সাহায্য করলেন বিদ্যাসাগর। সারা গায়ের মোদো গন্ধ আর পাগলামির ভিতরে বসে থাকা অমূল্য প্রতিভাটাকে বিদ্যাসাগরই চিনতেন। জানতেন যে মানুষটার যশ হবে না। সবাই বলবে শুধু ভাঙচুর করে গেছে। কিন্তু ওই ভাঙচুরটাও যে বাংলা ভাষার প্রয়োজন ছিল সেটা বিদ্যাসাগরই জানতেন।  

সতীশ   -       আপনি তো ওনার কাছে থেকেই পড়াশোনা করেছেন?

শাস্ত্রী    -       স্কুলে পড়ার সময়। আমার নন্দদাদা আর উনি প্রিয় বন্ধু ছিলেন তো। আর দেখ, কেমন ভাগ্য আমার। হেয়ার স্কুলে শিক্ষকের চাকরিটা পেলাম – দাদাও আর দেখার জন্য রইলেন না, ভাবলাম ইশ্বরদাদাকে প্রণাম করে আসি, গিয়ে শুনলাম তিনি এখানে। ভাগ্যিস লখনউয়ে এই এ্যাক্টিং স্যাংস্কৃট টিচারের কাজটা পেলাম, তাই আজ ইশ্বরদাদাকে প্রণাম করতে পারবো। কী হল, অত আস্তে আস্তে হাঁটছ কেন, শরীর খারাপ লাগছে, জ্বর আসেনি তো? একটু সাবধান থাকতে হবে আমাদের। তুমিও ম্যালেরিয়ার রুগী আর আমিও জ্বর থেকে উঠেছি।

সতীশ   -       ওই সামনের গেটটাই না?

শাস্ত্রী    -       ঠিক বলেছ, ওই তো, ডানদিকে লেখাই আছে ‘নন্দন কানন’। পান্ডববর্জিত টাঁড়ের শুকনো লালমাটিতে একা একা থাকার জন্য বাড়ির নাম ‘নন্দন কানন’ বিদ্যাসাগর মহাশয় ছাড়া আর কে রাখবেন। এই না হলে একটা মানুষের জন্য স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম উঁচু করিয়ে দেয় সরকার বাহাদুর? মনে আছে তো, কী বললাম! কর্মাটাঁড়ে এসে কেন থাকছেন, কবে কলকাতায় ফিরবেন, জিজ্ঞেস কোরো না। কী দরকার, একদিনের জন্যে তো এসেছি।

সতীশ   -       ওরেব্বাপ! ওখানে ঢোকার পর আমি বোবা। সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, সারা বাঙলার স্কুল ইন্সপেক্টর ছিলেন, দুশোটার বেশি স্কুল খুলেছেন, তারপর কত বই, সংস্কৃতের পন্ডিত, হিন্দু সমাজের সংস্কার করেছেন... বাপ্‌রে, গুনতি ভুলে যাবার যোগাড়, ইংরেজ সাহেবরাও সমীহ করে চলেন ... একটা প্রশ্ন করলেই তো আমি গেছি।

শাস্ত্রী    -       হাঃ হাঃ, গিয়ে দেখবে, উনি এক্কেবারেই সেরকম নন। খবর পেয়ে গেছেন তো আমরা আসছি। দেখবে কত কিছু খাবার আনিয়ে রেখেছেন।

 

                                    চতুর্থ দৃশ্য

 

[প্রথম ছেলেটি অথবা আরো কোনো একজন ঢুকে বাড়ির সামনের প্ল্যাকার্ডটা পাল্টে আবার করে দেয় ‘নন্দন কানন, কর্মাটাঁড়’। আলো দিয়ে সকাল বোঝা যায়। বিদ্যাসাগর বাড়ির বারান্দায় টেবিল চেয়ারে বসে বইয়ের প্রুফ দেখছেন। বাইরে থেকে বেড়িয়ে এলেন হরপ্রসাদ এবং সতীশ।]

 

ইশ্বর     -       ঘুরে এলি? কেমন লাগল জায়গাটা? আর আমার ওই কচি আমগাছগুলো? একটা দুটো করে আনিয়ে সব লাগিয়েছি। এবারের আনা চারাটার চারদিকে বেড়া দেওয়ালাম গতকাল।   

শাস্ত্রী    -       আপনি সেই ভোরবেলা থেকে এখনও প্রুফ দেখছেন? আর এ তো ‘কথামালা’ দেখছি। তাও প্রথম সংস্করণ নয়। এর প্রুফ তো আপনার দেখার প্রয়োজনও নেই। ছাপাখানার প্রুফ-রীডারও তো দেখে নিতে পারবে। (একটা ফর্মা উঠিয়ে) রাত জেগে জেগে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে...

ইশ্বর     -       আসলে ভাষা জিনিষটা এমনই। যতবার পড়ি, শব্দগুলো চোখের সামনে দিয়ে যায়, দৃষ্টি আটকে যায়, এখানে এ থেকে আরেকটু ভালো শব্দ দেওয়া যেতে পারতো না? ইস্‌, এই শব্দটা বাধছে। অর্থটা ঠিকই আছে কিন্তু দ্যোতনা কি ওই অর্থতেই ছড়াচ্ছে ... ? কিছুতেই মন স্পষ্ট হয়না,কাটকুট করে চলি সর্বদা। সে যা হোক, তোরা জলখাবার খাবি তো? (সতীশের দিকে তাকান) ভয় পেয়ো না। ক্ষেতের ভুট্টা তুলে হাতে দেব না। হা হা, ভালো জিনিষ আনিয়ে রেখেছি তোমাদের জন্য! তুমি এত ছোটো, নিজে আবার ম্যালেরিয়ার রুগী, কী করে যাবে অত দূর হরপ্রসাদের সাথে, ভাবতেই পারছি না। মহেন্দ্রনাথ বসু, তোমার বাবা, তার সাথে তো বিশেষ খাতির আছে আমার। তোমাকে ভালো করে না খাওয়ালে কী বলবেন মহেন্দ্রবাবু! কী আনিয়েছি তোমার জন্য জানো?   

শাস্ত্রী    -       সে ওর ঘুম চোখেই দেখা হয়ে গেছে। হাঁড়ি ভর্তি ছানাবড়া আর মতিচূর। কোত্থেকে আনালেন? বর্ধমান থেকে?

ইশ্বর     -       এখানে আর কোথায় পাবি ওসব?

                   (এক দল সাঁওতাল মেয়ে প্রবেশ করে। এসে নিজেদের মধ্যে হাসি-মস্করা ও ছুটোছুটি করতে থাকে। তারই মধ্যে থেকে একটি মেয়ে এগিয়ে আসে।)

মেয়ে    -       ও বিদেসাগর, কিছু খাবার দে আমাদের।

                   (বিদ্যাসাগর ঘরের দিকে যাওয়ার জন্যে ওঠেন।)

শাস্ত্রী    -       আপনি তো ওই দাম দিয়ে, না, দান দিয়ে, দান দিয়ে কেনা ভুট্টাগুলো এবার বিলোবেন। তার সাথে ওই মতিচূর ও ছানাবড়াও কয়েকটা দিয়ে দিন। এক এক হাঁড়ি খাবে কে?

ইশ্বর     -       আরে দূর! মতিচূর আর ছানাবড়া! কী ভেবেছিস, ওরা খুব অবাক হবে আর আনন্দে লাফিয়ে উঠবে? তারিয়ে তারিয়ে খাবে? ওদের শুধু খাবার চাই। যেমন ভুট্টা, তেমনই মতিচুর আর ছানাবড়া। ক্যোঁৎ করে গিলবে, খেয়ে নেবে। ওদের দিয়ে কোনো লাভ নেই। (ভিতর থেকে ভুট্টা বার করে এনে মেয়েদের দিতে দিতে) ওসবের সমঝদার লোকও আছে এখানে বুঝলি! এখান থেকে এক ক্রোশ দূরে একটা গ্রাম আছে, কোরা। সেখানে এক মারহাট্টা রাজা আছে। এক সময় যখন বাঙলায় বর্গীর আক্রমণ চলছিল সে সময় ওরা এখানে এসে ছোটোখাটো রাজত্ব গড়ে তোলে। সে রাজত্ব আর নেই। রাজা, ব্রাহ্মণ, সৈন্যসামন্ত, অন্য জাতের মানুষ সব মারহাট্টা ছিল, এখন সাঁওতালদের সাথে থেকে সাঁওতাল হয়ে গেছে। তবে ওই, ভালো খাবার যদি দাও, একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে খাবে, জিজ্ঞেস করবে, জিনিষটা কী, কী ভাবে তৈরি হয়েছে, কী কী দেওয়া হয়েছে, কোথা থেকে আনানো হয়েছে...

শাস্ত্রী    -       তাহলে এক কাজ করি। আমাদের সাথে লুচি আছে কয়েকটা। পরশু ভাজা। সেগুলো দিয়ে দিই ওদের।

ইশ্বর     -       আছে নাকি? কই, আন্‌ তো!

                   (হরপ্রসাদ ছুটে বেরিয়ে যান, স্টেশনের মালপত্র থেকে লুচির প্যাকেটটা বার করে আনতে। সতীশও বেরিয়ে যায়। বিদ্যাসাগর মেয়েগুলোকে হাঁক দেন।) এ্যাই মেয়েরা, এদিকে শোন। (মেয়েরা এগিয়ে যায়।) খিদে পেলে, ‘বিদেসাগর খাবার দে’ বলতে সাতজন – এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত – আর বিকেলে আমার ইস্কুলে আসতে দুজন? বাকিরা কোথায় থাকে? কে কে আসেনি পরশু?

                   (যে মেয়েটি এগিয়ে এসে খাবার চেয়েছিল সে নিজেকে আর আরেকজনকে আঙুল দিয়ে দেখায়।)

মেয়ে    -       আমরা দুজনে এসেছিলাম।

ইশ্বর     -       বাকি রইল ক’জন?

মেয়ে    -       (আস্তে আস্তে ভেবে ভেবে গোনে) এক... দুই... তিন... চার... পাঁচ। (বিদ্যাসাগরের দিকে

                   তাকিয়ে) পাঁচ।

ইশ্বর     -       (ওই পাঁচজনকে) আসো না কেন তোমরা?

                   (মেয়েগুলো চুপ থাকে। শেষে বিদ্যাসাগর ওই গুনতি করা মেয়েটিকেই ডাকেন; তখনই হরপ্রসাদ

                   ও সতীশ ঢোকে। হরপ্রসাদ কলাপাতার মোড়ক খুলে লুচিগুলো শোঁকেন)

শাস্ত্রী    -       গরম জিনিষ, পাতাগুলোকে সেদ্ধ করে দিয়েছে, লুচিতেও পাতার গন্ধ। দিয়ে দিই ওদের?

ইশ্বর     -       দাঁড়া, আমায় দে। ওভাবে দেয় নাকি। কলাপাতাগুলো মেলে লুচিগুলো ছড়িয়ে রাখেন তার ওপর।

                   দুটো উঠিয়ে হাওয়ায় নাড়েন। তারপর শোঁকেন) এই তো আর গন্ধ নেই। (দুটো আরো উঠিয়ে

                   মুড়ে ভিতরে রাখার জন্য ওঠেন)

শাস্ত্রী    -       ওটা কী করছেন।

ইশ্বর     -       খাবো রে! তোর মায়ের হাতে ভাজা?

শাস্ত্রী    -       না, বড় বউয়ের।

ইশ্বর     -       তবে আরো ভালো! নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বিধবা পত্নীর! বড় ভালো বন্ধু ছিলো আমার, নন্দকুমার। (নিজের জন্য ভিতরে রেখে এসে আরো কয়েকটা লুচি তুলে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলেন) নে খা। আর তুই যখন পালের গোদা তুই সবাইকে টেনে নিয়ে আসবি আমার ইস্কুলে, মনে থাকবে! (হরপ্রসাদের উদ্দেশ্যে) দেখলি, কেমন করে গপ গপ করে খেয়ে ফেললো লুচিগুলো। না রস বুঝলো না স্বাদ! (সাঁওতাল মেয়েগুলো বেরিয়ে যায়)। চল, বেলা হয়ে গেল। তোরা জলখাবার খেয়ে নে। একটু ঘুরে আয়। (দুজনকে নিয়ে ভিতরে চলে যান)

 

 

পঞ্চম দৃশ্য

 

[প্রথম ছেলেটি এসে একটা বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে দর্শকদের বলে, “এখানে মাটিতে বাঁধানো একটা আসন ছিল।   বিদ্যাসাগর বিকেলে এখানে এসে বসতেন। এখানেই আজ প্রতিমাস্থাপন এবং অনাবরণ হবে।” বলে বেরিয়ে যায়। বিদ্যাসাগর সেখানে এসে বসেন। সামনে পাঁচজন বয়স্ক সাঁওতাল পুরূষ এসে বসেন।]

 

ইশ্বর     -       (একটা স্লেট আর স্লেটপেন্সিল মাটি থেকে উঠিয়ে নেন) এ জিনিষদুটো তোমাদের কাছে আজ নেই। আমি কলকাতা থেকে কয়েকটা আনাবার ব্যবস্থা করেছি। আর বই, সবাইকার হাতে একেকটা দিয়েছি? (সবাই ‘হ্যাঁ’এ মাথা নাড়ে) তবে, বই ধরে শুরু করার আগে একটা খেলা খেলি। আমি এক এক করে তোমাদের নাম লিখবো। দেখবো কে কে নিজের নাম চিনতে পারো। তবে তারও আগে (স্লেটে বড় করে লেখেন, ‘সাঁওতাল’), বল তো, কী লিখলাম? (স্লেটটা ওদের দিকে এগিয়ে দেন)

                   (ওরা এক এক করে স্লেটটা নেয়। লেখাটা দেখার আগে স্লেটটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে) ওটাকে বলে স্লেট। চারদিকে কাঠের তৈরি খাপ আর মাঝখানে পাথর বসানো। ওই পাথরটাকে স্লেট পাথর বলে। ওরকমই হয়, পাতলা ফালির মত, গায়ে গায়ে লেগে বড় পাথরখন্ড হয়ে থাকে। ফালিগুলোকে আলাদা করতে হয়, মসৃণ করতে হয়, কেটে চৌকো করে ওই খাপটা আটকাতে হয়। পাথরটা আমাদের দেশেও হয়। তবে জিনিষটা ইংরেজরা নিয়ে এসেছে এদেশে। এখন এদেশেও তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। ...কেউ পড়তে পারল লেখাটা? (সবাই ‘না’এ মাথা নাড়ে। ততক্ষণে প্রথম দৃশ্যের মোড়ল ঢোকে। গাঁএর বাকি মানুষদের পাশে না বসে একটু তফাৎ রেখে বসে।) তুই পারিস পড়তে? (মুখ না তুলে কাঁদতে থাকে) কী হল?

মোড়ল -       বুড়িটা মরে গেল রে দেওতা! (বিদ্যাসাগর থমকে যান। বাকি সকলেও থমকে যায়। তারপর দু’একজন প্রশ্ন করে)

দু’একজন-     কোন বুড়ি? কার কথা বলছে মোড়ল?

ওদেরই

একজন -       আমাদের, বারমুন্ডির, সুবি মুর্মু, সবাই ঠানদি বলতো।

দু’একজন-     কী হয়েছিল?

সেজন   -       হবে আবার কী। সাত বুড়ির এক বুড়ি। বয়সের গাছপাথর নেই। মরবে না? একা মানুষ। এতদিন বেঁচেছিল তা শুধু আমাদের এই ইশ্বর-দেওতার সেবায় আর ওষুধে। দিনের পর দিন গিয়ে বুড়ির পায়ে তেল মাখিয়ে দিয়ে এসেছেন। ওষুধ খাইয়ে এসেছেন। 

ঈশ্বর    -       চেয়েছিলাম এই শীতটা অন্ততঃ পার করে যাক। গরম এলে আপনিই কিছুটা আরাম হত। পারলাম না। দেখলি তো। এই জন্য তোদের মানা করি দেবতা বলতে। সাধারণ মানুষ আমি।

মোড়ল -       (প্রায় ঝগড়ার মত করে) এবার তুই বোকার মত কথা বলছিস। বাঁচামরা দিয়ে দেওতা হয়? তাহলে তো কেউ মরতই না। (আকাশের দিকে আঙুল তুলে) ভগবান তো সব দেওতার বড়। মরত কেউ? যারা বড় মানুষ, ভালো মানুষ, আমাদের রাস্তা দেখায়, হাত ধরে, তারাই দেওতা। (ইতিমধ্যে দ্বিতীয় দৃশ্যের চাষী ও তার বৌ ঢুকেছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে তারা একটু দূরে।)

চাষী     -       ভূল দিনে এসে পড়লাম বিদ্যেসাগর মশাই। মেয়েদের টোলটা কবে করেন?

ঈশ্বর    -       ভূল দিন বলে কিছু হয়না ভাই লেখাপড়ায়। আমিই তো বলেছিলাম ব্যবস্থা করে দেব। তবে সেটা হতে আরো এক সপ্তাহ দেরি হবে। আমার ওই বাড়িরই বারান্দায় ব্যবস্থা হবে ইস্কুলের। তাহলে আলাদা বসার আর পর্দার ব্যবস্থা করতে পারব। তা এসেই যখন পড়েছ মা, তুমিও শুরু করে দাও তো। (চাষীকে) ওই স্লেটটা ওকে দাও। (বৌটিকে) হ্যাঁ, তুমি পড়তে পারো কী লেখা আছে স্লেটটায়?

চাষীবৌ -       (বানান করে পড়ে) স, সএ আকার, ওপরে এটা কী?

ঈশ্বর    -       চন্দ্রবিন্দু বলে ওটাকে। ওটা থাকলে সব মিলিয়ে হবে ‘সাঁ’।

চাষীবৌ -       সাঁ, ও, ত, তএ আকার, তা, ল। সাঁ, ও, তা, ল। সাঁওতাল!

ঈশ্বর    -       ঠিক ধরেছিলাম আমি সেদিন। তুমি জানো। তাই আরো শেখার নেশাটা আছে। (বাকি বয়স্ক গ্রামীণদের) দেখলে, তোমরা সাঁওতাল। অথচ ‘সাঁওতাল’ এই সুন্দর কথাটা পড়তে পারলে না। সামনের সপ্তাহ থেকে তোমাদের জন্য বারান্দায় জায়গাও তৈরি হয়ে যাবে আর স্লেটও চলে আসবে। নিয়মিত আসতে হবে কিন্তু। (চাষীবৌকে) আর তুমি মেয়েদের স্কুলটাতেই এসো। তুমিই হবে এ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার, আমার সহায়ক। ছটফটে মেয়েগুলো তো বসতে চায় না, শুধু খেলার মতলব, তুমিই ওদের বসাবে, অক্ষরজ্ঞান করাবে। একটা ব্ল্যাকবোর্ডও আনাবো ভাবছি। তাহলে আজ যাও। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।

                   (সবাই বেরিয়ে যায়। বিদ্যাসাগর উঠে বাড়ির ভিতরে চলে যান।)

 

[স্টেজের আলো কমে আসে। সন্ধ্যা। দলে দলে সাঁওতাল মেয়েপুরূষ ঢোকে। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঠটায় বসে। কাঠকুটো জোগাড় করে আগুন জ্বালায়। বিদ্যাসাগর ঘরের ভিতর থেকে একটা চাদর জড়িয়ে, হাতে একটা আলো নিয়ে এসে চেয়ারে বসেন। কাগজপত্র টেনে নিয়ে তাঁর কাজও করতে থাকেন। সাঁওতালদের দু’একজন তাঁর হাতের ইশারায় ঘরের ভিতর থেকে কয়েক গোছা ভুট্টা নিয়ে এসে সবাইকে ভাগ করে দেয়। তারা আগুনে ভুট্টা সেঁকে খেতে খেতে গান গাইতে থাকে।]       

 

 

ষষ্ঠ দৃশ্য

 

[আগের শেষ দৃশ্যের ওপর সামনের দিকে আলো জ্বলে ওঠে। আলোটা আস্তে আস্তে পিছনে ছড়িয়ে পড়ে। যে বিদ্যাসাগর সেজেছিল সে স্টেজের সামনের দিকে এসে নেপথ্যে হাঁক দেয়। প্রথম ছেলেটি, অর্থাৎ নাটকের নির্দেশক ঢুকে বাড়ির সামনে লাগানো প্ল্যাকার্ডটা খুলে নেয়]

 

ছেলেটি -       যা, তুই জামাকাপড়টা পাল্টে নে। অবশ্য এই ড্রেসেও থাকতে পারিস। মন্দ লাগছে না। (নেপথ্যে ডাকে) এবার একটু হাত লাগাও ভাই সবাই! সবাই এসে পড়বেন। (সাঁওতাল মেয়েরা উঠতে যায়, ওদের বাধা দেন) তোরা কোথায় চললি?

মেয়েরা -       যাচ্ছিনা, আসছি এক্ষুণি, ফুল আনতে হবেনা বিদেসাগর-দেওতার জন্য? তোদের ডারেক্টার তো রাস্তা থেকে টেনে এনে আমাদের বসিয়ে দিল। আমরা ফুল টুল নিয়ে পরে আসতাম। (দল বেঁধে বেরিয়ে যায়। ওদিকে দুটো ছেলে ডানদিক থেকে টানতে টানতে নিয়ে আসে পেডেস্টাল সুদ্ধু বিদ্যাসাগরের আবক্ষ-প্রতিমা।)

ছেলেটি -       (সামনে দর্শকদের উদ্দেশ্যে) প্রায় একশ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়েছিল ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এই নতুন কর্মভূমি – কর্মাটার। শেষে বিহার বাঙালি সমিতির প্রচেষ্টায় কর্মাটারের এই নন্দন কানন বাঁচানো গেল। আপনারা জানেন বিহারের বিভাজনের পর এখন কর্মাটার শহর, স্টেশন বিদ্যাসাগর ঝাড়খন্ডের জামতাড়া জেলার অন্তর্গত। তা সেই ১৯৯২এ প্রতিমাস্থাপন থেকে আজ এই দ্বিশত জন্মবার্ষিকী অব্দি আমরা এই নাটকে একসাথেই ধরার চেষ্টা করব। লড়াইটা চলছে। এই ভাষাতীর্থ গড়ে তোলার।

                   (একজন ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে ঢোকেন। সঙ্গে তাঁর দুজন সহায়ক।)

ডাক্তার -       সরি। একটু দেরি করে ফেললাম বোধহয়। কোথায় বসব আমরা। (প্রতিমা টেনে নিয়ে আসা ছেলে দুজনের একজন এগিয়ে আসে)

ছেলেটি২ -     আপনি তো চোখের ডাক্তার। মিহিজাম থেকে। ক্যাম্পের জন্য এসেছেন তো। আমার সাথে আসুন। (ডাক্তার এবং সহায়কদের নিজের সাথে নিয়ে যায়। ডাক্তারের ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়।)    

                   (কয়েকটি মেয়ে এবং ছেলে ঢোকে। তারা প্রতিমার সামনে একটা পর্দা টাঙানো, ফুল ইত্যাদি দিয়ে জায়গাটা সাজানো এবং আলপনা দেওয়ায় মেতে ওঠে। একজনের হাতে ফেস্টুন/ঝান্ডি লাগানো দড়ি – এক  প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অব্দি টাঙালে দেখা যায় তাতে বাংলা বর্ণগুলো লেখা আছে।)

ছেলেটি৩-      (এগিয়ে এসে) এতো গেল সাজসজ্জা। এরপর হবে শ্রদ্ধানিবেদন। কিন্তু দায়? বিদ্যাসাগর তো এখানে এসেছিলেন অসুস্থ শরীর নিয়ে, পেটে দুরারোগ্য ব্যাধি, খোঁড়া পা... একটু অবসর নিতে, আরাম করতে। ইতিহাসে যাকে বলে অক্ষয় অবদান, তা তো তিনি রেখে এসেছিলেন কলকাতায়, সারা বাংলায়। দিনের পর দিন স্মার্ত পন্ডিত আর রক্ষণশীল বাঙালি ভদ্রলোকেদের ব্যক্তিগত আক্রমণ সহ্য করেও যা তিনি ভেবেছিলেন, করেছিলেন। রামমোহনের সতীহত্যারোধ আর বিদ্যাসাগরের বিধবাবিনষ্টিরোধের ভিত্তিতে আজ আমরা নারীমুক্তি আন্দোলনের কথা বলছি। (আলপনা দিতে থাকা একটি মেয়ে এগিয়ে আসে)

মেয়েটি -       বাংলা বর্ণমালার তিনি কারিগর; তাঁকে গুরু করে আমরা মাতৃভাষা শিক্ষার কথা বলছি; আমরা শিক্ষার অধিকারের কথা বলছি। (আরেকটি ছেলে এগিয়ে আসে।)

ছেলেটি৪ -     ঝড়ে জলে বৃষ্টিতে নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুরে ঘুরে এই কর্মাটাঁড়ের গ্রামে গ্রামে তিনি গরীব মানুষের চিকিৎসা করেছেন, সেবা করেছেন, কলকাতা থেকে উন্নত বীজ নিয়ে এসে, চাষের নতুন পদ্ধতি জেনে এসে তিনি এখানকার চাষীদের শিখিয়েছেন, সেই সুত্র ধরে আজ আমরা প্রান্তিক জনতার উন্নয়নের প্রশ্নগুলো তুলে ধরছি। স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা বলছি।

(একদল মানুষ ঢুকে পড়ে। তার মধ্যে মন্ত্রী, সান্ত্রী, বাঙালি সমাজের নেতারা আরো অনেকে আছে। তারি মধ্যে অন্য দিক থেকে কয়েকজন পুরূষ ও মহিলা ‘জিন্দাবাদ’এর স্লোগান দিতে দিতে সামনে চলে আসে। সান্ত্রীরা ওদের আটকায়। বাঙালি সমাজের হর্তাকর্তাদের দুএকজন এগিয়ে আসেন।)

হর্তাকর্তা-      কী ব্যাপার!

স্লোগান দিতে

থাকা দলের

একজন -       হামরা মন্ত্রীজীকে আবেদন দিতে এসেছি।

হর্তাকর্তা-      কিসের আবেদন?

একজন -       (সোজা মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে) ইহাঁ কা বালিকা বিদ্যালয় ইন লোগোঁনে অচানক বন্ধ্‌ কর দিয়া, মন্ত্রীজী! হামসাব কা তিন চার মাহিনে কা তনখাহ বাকি হ্যয়।

মন্ত্রী      -       (হর্তাকর্তার উদ্দেশ্যে) কেয়া বাত হ্যয়?

হর্তাকর্তা  -    বংগলা মিডিয়াম স্কুল খোলা থা হাম লোগো নে। কিসী তরহ চন্দা ইকট্‌ঠা করকে ইতনা সাল চলায়া। আব ন চন্দা দেনেওয়ালে হ্যঁয়, না বচ্চে হ্যঁয় পঢ়নে ওয়ালে। ইনসে হমারা ওয়াদা হ্যয়, ইনকি তনখাহ থোড়া থোড়া করকে দে দেংগে। পর স্কুল, বিদ্যাসাগর কী কর্মভূমি পর খড়া হোকর বোলনে মেঁ শর্ম আতী হ্যয়, বংগলা মিডিয়ম মে অব চল নহী পায়েগা। অংরেজি মিডিয়ম খোলনে কে লিয়ে কুছলোগ বোল রহে হ্যঁয়। ওয়সে আপ সরকার হ্যঁয়, হমনে কই প্রস্তাও আপকো দিয়ে হ্যঁয় ...

মন্ত্রী      -       ঠিক হ্যয়, (দু তরফকেই) হম বিচার করেংগে। (হর্তাকর্তাকে) অগর অংগ্রেজি স্কুল খুলে তো

                   ইনহে অগ্রাধিকার দিজিয়েগা, ইয়োগ্যতা কে মুতাবিক।

হর্তাকর্তা -     জী, বিল্কুল সরকার! ইয়ে ইনসে কহা হুয়া হ্যয়।

                   (সবাই চলে যায় প্রতিমা অনাবরণের দিকে।)

সেই প্রথম

ছেলেটি -       দেখুন কী অবস্থা! বাংলাভাষাই শেষ হয়ে আসছে।

মেয়েটি -       শিক্ষার অধিকারই কি সদর্থে বলবৎ? আর নারীদের কী অবস্থা আজ দেশে?

ছেলে২ -       কত বলব? তবু এক মহামানবের পথে চলব! মানুষের দিকে, তার জীবনসংগ্রামের দিকে থাকব সব সময়!

                   (ওদিকে প্রতিমা অনাবরণ সম্পন্ন হয়। হাততালি দেয় সকলে। একটি ব্যানার মেলে ধরে তিনজনে মিলে –

‘বিদ্যাসাগর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী

নারীর অধিকারের পথে

মাতৃভাষার অধিকারের পথে

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকারের পথে

বঞ্চিত মানুষের অধিকারের পথে’)

 

 

মাপ্ত

বর্ণপরিচয়