কাটিহার থেকে মীরার গল্প - ডোরেমন


(১)
আজ আমার রিক দাদাভাইয়ের বিয়ে। সারাবাড়িটা যেন আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে। সবাই আজ কত খুশি! নতুন বৌমণি ঘরে আসবে বলে কথা। আমার দাদাভাইটাকেও বরের বেশে দিব্যি কোনও রাজকুমারের মতন দেখতে লাগছে। অবশ্য আমি এই বিয়ের অংশ নই বললেই চলে। সবার মাঝে আমি যেন বড্ড বেমানান আমার এই অন্ধকার মুখ নিয়ে। ওই যে দাদাভাইয়ের খাটের পাশটা, ওইটাই আমার সব থেকে প্রিয় জায়গা। কিন্তু আমি জানি, আর কদিন পর ওখানেও আমার আর কোনও অধিকার থাকবে না। যার ঘরটাই কোনদিন নিজের ছিল না, তার আবার অধিকার কিসের!

(২)
আমি যখন প্রথম এবাড়িতে আসি, তখন দাদাভাইয়ের পনেরো-ষোলো বছর বয়স। আর আমি! তখন আমি দুমাসের ফুটফুটে শিশু। আমার দুধসাদা রং আর লেজে ও উপর কালোর ঈষত রেখা দেখে দাদাভাই বলেছিল, "হাউ কিউট, আমি এই কিটেনটাকে আমার কাছেই রাখব। ও আমার বন্ধু হবে। " মামণি অবশ্য প্রথম কমাস আমায় বিশেষ সুনজরে দেখেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনিও আমায় ভালবাসতে শুরু করেন। বাড়ির সবার আদরের ছিলাম আমি, বাড়ির আরেক ছেলে। দাদাভাই আদর করে আমার নাম রেখেছিল 'ডোরাম'। ভাবছেন এই অদ্ভুত নাম রাখার কারণ কি? আরে ওই যে, টিভিতে 'ডোরেমন' নামক যে বিড়ালটিকে আপনারা সর্বদাই দেখতে পান, সে ছিল আমার দাদাভাইয়ের অত্যন্ত প্রিয়। তার নামের সাথেই মিলিয়ে রাখা হয়েছিল আমার নামটা। সবসময় দাদাভাইয়ের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ানোটাই ছিল আমার কাজ। আর দাদাভাইও সময়ে অসময়ে আমায় কোলে তুলে আদর করতে কার্পণ্য বোধ করত না। সময়ের সাথে সাথে আমরা দুজনেই বড়ো হয়ে উঠি। এখন দাদাভাইয়ের নিজস্ব একটা জগত তৈরী হয়েছে। ওর বন্ধুবান্ধব, হইহুল্লোড়ের মাঝখানে আমার জায়গাটা ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। এখন দাদাভাই আর আগের মতন আমার সাথে খেলা করেনা। প্রাণ খুলে হাসি গল্প করেনা। হয়তো মাঝেসাঝে এক আধবার কোলে তুলে শুকনো আদর করে। ব্যস, ওইটুকুই। আমিও আজকাল ওর ঘরে মনমরা হয়ে বসে থাকি। ওর জীবন থেকে যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। এরপর, ওর জীবনে এল বৈশালী দি, ওর প্রেমিকা। ব্যস, এতদিন যেটুকু ভালোবাসা মনোযোগও আমায় দিত দাদাভাই, সেটুকুও এবার বৈশালীদির ভাগে চলে গেল। এরপর, ওর জীবনে আমার গুরুত্বও সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে গেল।

(৩)
শুনেছিলাম, আমার  নতুন বৌমণি, বৈশালী দি নাকি পশুপাখি বিশেষ পছন্দ করেনা। অতএব, প্রেমিকার  মন রাখতে দাদাভাই পত্রপাঠ আমাকে ঘর থেকে বিদায় করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, এতদিনের পুরোনো আবাস, তার স্মৃতি ছেড়ে কি এত সহজে যাওয়া যায়? আমিও যেতে চাইনি কিন্তু ওরা আমায় বাধ্য করেছে। আমায় ব্যাগে ভরে দূরের ওই জঙ্গলটায় ছেড়ে আসার কথা আলোচনা করেছিল 'পরিবার'। কিন্তু, ওরা ছেড়ে আসার আগে আমিই এই বাড়ি থেকে চিরতরে চলে যাব। বৃদ্ধ হয়েছি আমি এখন। আর কটা দিনই বা বাঁচব! তবে, শেষ বয়সে স্বজন হারানোর যন্ত্রণাও যে আমায় ভোগ করতে হবে, তা আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি। আমার বড় হয়ে ওঠার পিছনে, আমায় একটা সুস্থ জীবন দেবার পিছনে ওদের অবদান আমি কখনওই অস্বীকার করতে পারব না। কিন্তু তাও এসব দেখে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে মানুষ কি সত্যিই এতটা স্বার্থপর হতে পারে? জানেন, ছোটবেলায় দাদাভাই সবসময় আমায় বলত, "ডোরাম, ওই যে টিভিতে নোবিতা আর ডোরেমনকে দেখছিস, ওদের থেকেও গভীর আমাদের বন্ধুত্ব। তুই-ই আমার ডোরেমন। আমার জীবনে আর যেই আসুক না কেন, তোর আর আমার বন্ধুত্বের মাঝে কোনওদিনও ছেদ পড়বে না দেখিস।" সত্যিই কি তুমি তোমার কথা রাখতে পেরেছ দাদাভাই? তোমার ভালোবাসাও কি আর সবাইয়ের মতনই সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছিল? জীবনে নতুনের আগমনের সাথে সাথে তুমি পুরোনো বন্ধুত্বকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিতে পারলে? নোবিতার জীবনেও তো প্রেমিকা এসেছিল, কিন্তু তাই বলে সে তার পুরোনো বন্ধুকে তো ভুলে যায়নি। যদি আমায় ভালোই না বেসেছিলে, তবে কেনই বা আমাকে তোমার চিরসাথী বানানোর মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করেছিলে? উত্তর আছে কি?

4 comments:

  1. গল্পঃ টি অসাধারণ ।

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর লেখা হয়েছে।

    ReplyDelete
  3. আমার বাংলা টা ঠিক ভালো না অতটা ,কিন্তু গল্পঃ টি পড়ে খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete

বর্ণপরিচয়