অখিল ভারতীয় বাঙালি একতা মঞ্চ্: উত্তরাখন্ড: জাতি প্রমাণ পত্র


 

অখিল ভারতীয় বাঙলী একতা মঞ্চ

 


ঝাড়খন্ড বঙ্গভাষী জাগরণের ১৯ তম সংখ্যার উন্মোচন: বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা সমিতি, ঝাড়খণ্ড

 

ঝাড়খন্ড বঙ্গভাষী জাগরণের ১৯ তম সংখ্যার উন্মোচন



ভারত সেবাশ্রম সংঘের দুমকা শাখার রানিশ্বর এর আবাসিক বিদ্যালয়ে শুক্রবার মহাসপ্তমীর দিন, নিয়ম বিধি মেনে আনুষ্ঠানিক রূপে ঝাড়খন্ড বঙ্গভাষী জাগরণের ১৯ তম সংখ্যার উন্মোচন হল। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা সমিতি, ঝাড়খণ্ডের পক্ষ থেকে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার বিকট পরিস্থিতির মধ্যে পত্রিকা প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সমিতি সক্ষম হয়েছে। নব কুমার ঘোষ এর আগমনী গানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। উন্মোচন করেন বিশিষ্ঠ লেখক অজিত রায়, জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতির জাতীয় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ড. কাশীনাথ চ্যাটার্জি, আশ্রমের স্বামী নিত্যব্রতা নন্দ পত্রিকার সম্পাদক তীর্থ পৈতান্ডি  প্রকাশক ও সমিতির স্টেট সেক্রেটারি গৌতম চট্টোপাধ্যায়। উন্মোচন অনুষ্ঠানের পরিচালন করে অনিমেষ মণ্ডল, সমাপ্ত ঘোষণা করে বিমল মোদী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কৌশিক অধিকারী, কুন্দন অধিকারী, বিশ্ব রূপ চ্যাটার্জি, খোকন চক্রবর্তী, রুদ্র গড়াই, প্রদীপ ঘোষ, চন্দন চ্যাটার্জি, বাবু বাউরি, কানাই পাল, শ্যাম রায়, তাপস রায়, অসীম সেন ও চন্ডী লায়েক। ৬৮ পাতার পত্রিকায় আটটি কবিতা ও ১৩ টি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন - গৌতম চট্টোপাধ্যায়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি ও ঝাড়খন্ড বঙ্গভাষী সমন্বয় সমিতি

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর:  ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি

আপনারা হয়তো জানেন যে পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের প্রায় অর্ধেক জেলাগুলোতে প্রায় সকল শ্রেণীর লোকেদের বোল চালের ভাষা হলো বাংলা। ঝাড়খন্ড আলাদা রাজ্য হওয়ার আগে (অর্থাৎ বিহারের আমলে) এই সব অঞ্চলগুলোর প্রায় সব কটি স্কুলেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে  ছেলে- মেয়েদের বাংলা  ভাষার মাধ্যমেই পড়াশুনা করানোর ব্যবস্থা ছিল।



আলাদা রাজ্য হওয়ার পর গত ২০ বছরে ঝাড়খণ্ডের এই বাংলা ভাষা অধ্যুষিত এলাকার মানুষজন বিকাশ রুপি লোলিপপ এর  স্বাদ পেয়েছেন  কি না জানি না তবে এটা নিশ্চিত যে তাঁরা তাদের ছেলে- মেয়েদের  মাতৃভাষা (বাংলা)র মাধ্যমে লেখা পড়া করানোর সুযোগটুকু হারিয়েছেন।

এই সব অঞ্চলে বাংলা ভাষার দহনের কাজ এখানকার বৃহৎ পুঁজির মালিকেরা (যারা এখানকার মানুষদের নানান ভাবে বিভ্রান্ত করে এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ জল, জঙ্গল, জমি, জন ও খনিজ পদার্থ লুট করে নিজেরা মালা মাল হতে পারে তার সুযোগ সন্ধানী) শিক্ষা প্রশাসক, সব কটা রাজনৈতিক দল (বাম ও দক্ষিণ পন্থী) ও মিডিয়ার লোকেদের সঙ্গে নিয়ে অতি সুপরিকল্পিত ভাবে  করেছে ও এখনও করে চলেছে।

এখানকার নিরীহ মানুষজন সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য বা সরকারি লাভ পাবার জন্য বাংলা ভাষা কে ত্যাগ করে দিতে সেই চক্রান্তকারীদের ফাঁদে পড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা আজও জানেন না যে বাংলা ভাষার সাথে এক উন্নত নীতি নৈতিকতা ও সংস্কৃতির সাথে সাথে ভাষা - সংস্কৃতি ও মানব সমাজের বিকাশের উন্নতি করার সংগ্রামের ইতিহাস লুকিয়ে আছে যেটা হিন্দি বা অন্য কোনো ভারতীয় মাতৃভাষা দিয়ে পূরণ করা যাবে না।

আজ প্রয়োজন এই সব বাংলা ভাষাভাষী নিরীহ জনগণের মধ্যে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার।

ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতির সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মাননীয় কাশীনাথ চ্যাটার্জী মহাশয়ের প্রেরণায় দুটি বাংলাভাষী গ্রামে (প্রথম পটমদা ব্লকের  অন্তর্গত কাশ্মার গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন গোলকাটা মাঝিডিহ গ্রাম দ্বিতীয় ঐ অঞ্চলেরই কুমির গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন লেকড়াকোচা), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ২০০ বছর জন্মজয়ন্তী পালনের উপলক্ষ্যে বর্ণপরিচয় বই এর এক কপি প্রতি বাড়ি বাড়ি বিতরণ করি। তাদের বাড়ির মায়েদের বাংলা  ভাষায় (বলা ও লেখা - পড়ার)  প্রচলনকে অব্যাহত রাখার চেষ্টা শুরু করা হয়েছে

আমাদের এই সামান্য প্রয়াসকে যে কোনো ভাবে সমর্থন জানাতে সকল সুহৃদ বন্ধু বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষী ও বাংলাভাষীপ্রেমীদের অনুরোধ জানাই।

ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি, ঝাড়খন্ডঝাড়খন্ড বঙ্গভাষী সমন্বয় সমিতি

গত ১৮.১০.২০২০ ঝাড়খন্ড বঙ্গভাষী সমন্বয় সমিতি’র পক্ষ থেকে জামশেদপুর নিবাসী সন্দীপ সিন্‌হা চৌধুরী বাবু, তাঁর স্ত্রী - কন্যা সহ দুই সদস্য দেবরাজ দাস ও অনুপম ঘোষ নিয়ে আমাদের সেই দুটি আদিবাসী গ্রামটি দেখতে ও পরিচয় করতে এসেছিলেন, ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি, ঝাড়খন্ড এর তরফ থেকে মাতৃভাষা বাংলাকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছি।


ওনারাই প্রথম আমাদের সেই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে আমাদের এই পরিকল্পিত কাজের রুপায়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের ৫৫ টা বর্ণপরিচয় ও ২১ টা কিশলয় প্রথম শ্রেণী পাঠ্য পুস্তক দান করলেন। আমরা তাঁদের এই মহৎ কাজের জন্য সাধুবাদ জানাই।

এর পর আমরা আপনাদের সকল বাংলা প্রেমীদের কাছে অনুরোধ করবো সেই গ্রামে বাংলা ভাষায় পঠন পাঠন শুরু করতে যে তিনজন (ঐ গ্রামেরই শিক্ষিতা মহিলাদের নির্বাচিত করে) শিক্ষিকা হিসাবে নিযুক্ত করা হবে। তাদের মাসোহারা (অন্তত পক্ষে ৬ থেকে ১২ মাস অব্দি) কম পক্ষে ১০০০ টাকা প্রতি শিক্ষক আর্থিক সাহায্য দানের স্পনসরশিপের জন্য  হাত বাড়িয়ে দেবেন।

শ্রী সন্দীপ সিন্‌হা চৌধুরী জানান যে – গত নভেম্বর ২০০৯ সালে ঝাড়খণ্ড বঙ্গভাষী সমন্বয় সমিতির ভাষারথ”এ শুভ সূচনা করেন শ্রীপার্থ দে, মাননীয় প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আমরা এক (১) লক্ষ কিশলয় বই পেয়েছিলাম শ্রীসুদর্শণ রায়চৌধুরী উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রীর উদ্যোগে এবং দশ (১০) হাজার কপি বর্ণপরিচয় পেয়েছিলাম সর্বভারতীয় বঙ্গভাষী সমিতির উদ্দ্যগে। সেই সময় সর্বভারতীয় বঙ্গভাষী সমন্বয় সমিতি সভাপতি ছিলেন শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়  ঝাড়খণ্ড বঙ্গভাষী সমন্বয় সমিতির সভাপতি ছিলেন শ্রী বিকাশ মুখার্জী।

প্রতিবেদন – ড০ মদন সরকার

বিদ্যাসাগর - নবজাগরণ প্রয়াস, কর্মাটাঁড় ও বর্তমান অবস্থান: শাশ্বতী নন্দ

 বিদ্যাসাগর- নবজাগরণ প্রয়াস, কর্মাটাঁড় ও বর্তমান অবস্থান


শাশ্বতী নন্দ


(মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থা, কলকাতা, উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস পত্রিকা, নিউ দিল্লি ও বেঙ্গল এসোসিয়েশন, নিউ দিল্লি'র পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য)

 

উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মের কিছু আগে থেকেই বাঙালি সমাজের অচলায়তন কিছুটা হলেও সচল হতে শুরু করেছিল। “আধুনিক সভ্যতার ঘাতপ্রতিঘাতে ভারতীয় সমাজের আর নিশ্চল থাকবার উপায় রইল না- কলকাতায় ও তার কাছাকাছি ইংরেজ কেন্দ্রে চক্ষের উপর তারা দেখতে পেল আধুনিক সভ্যতার দুর্জয় রূপ- রাষ্ট্রে, বাণিজ্যে, লুণ্ঠনে, বেপরোয়া শক্তিমান শাসক পুরুষদের দৃপ্ত আবির্ভাব- কী তাদের যুদ্ধশক্তি, সংগঠনশক্তি, নির্মম কর্মশক্তি, দানবীয় ক্রূরতা খলতা, এবং সেই সঙ্গেই সৃষ্টিশক্তি, জ্ঞানের পিপাসা।” রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে সূচিত হল সেই চলমানতার প্রকাশ্য প্রয়াস। বালক ঈশ্বরচন্দ্র ১৮২৯ সালের মাঝমাঝি যখন কলকাতায় এলেন সেই বছরের শেষেই সতীদাহ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হল, ততদিনে শুরু হয়ে গেছে ডিরোজিও তথা ইয়ংবেঙ্গল পর্ব। জ্ঞানান্বেষণ’, ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’- ইয়ংবেঙ্গলের এইসব পত্রপত্রিকা, পরবর্তীকালে ১৮৩৯ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভা’, ১৮৪১ সালে শুরু অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা জাতীয় কাগজ এইসব সংস্কার প্রয়াসকে আরও প্রগতিশীল করায় সামিল হল এইসময়েই সংস্কৃত কলেজের কৃতি স্নাতক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অক্ষয়কুমার দত্তের সঙ্গে পরিচিত হন আর তত্ত্ববোধিনী সভায় যোগদান করেনসমকালীন শ্রদ্ধেয় এমনই অনেক সংস্কারপ্রয়াসী মানুষদের ও তাঁদের এইসব চিন্তাধারা কাজকর্মের মধ্যে তবু বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট

আসলে বিপুল পাণ্ডিত্য, সুবিপুল মানবতা, অর্থ সামর্থ্য ধৈর্য শ্রম, বাস্তবচেতনা সব নিয়ে তিনি শুধু কথায় নয়, নিজেকে সার্বিকভাবে নিয়োজিত করেছিলেন বিভিন্ন সমাজসংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞে। বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে গান্ধীজীর মূল্যায়নও তাই এমনই- “Beginning with Ram Mohan Roy, one heroic figure after another raised Bengal to a position higher than that of the other provinces. It can be said that Ishwarchandra Vidyasagar was the greatest among them.”।

 

তাঁর জীবদ্দশায় সর্বাধিক আলোচিত ও আলোড়নসৃষ্টিকারী সংস্কারপ্রয়াসগুলি হল বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ ও প্রচলন করা, হিন্দু কুলীনদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা রোধের চেষ্টা, নারীশিক্ষার প্রসার, প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতি প্রনয়ণ, শিক্ষক-শিক্ষণ প্রণালী স্থির করা ও বিদ্যালয় স্থাপন অক্লান্ত একাগ্র উদ্যোগে তিনি বিভিন্ন সমাজসংস্কারের পক্ষে তাঁর নিরলস ক্ষুরধার ওজস্বী লেখনীতে পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন, তাদের প্রচারের ব্যবস্থা করে জনমত গঠনের চেষ্টা করেছেন, বিশিষ্ট পণ্ডিত মানীগুণি ধনী ব্যক্তিদের সম্মতি সম্বলিত আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠিয়ে তা আইনসিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন এখানেই শেষ নয়, সফল হওয়ার পরও সেইসব সংস্কারকে সামাজিক ক্ষেত্রে কার্যকরী করতে নিরলস ব্যাপৃত থেকেছেনএছাড়াও ব্যক্তিগত ঋণবদ্ধ আর্থিক বিনিয়োগের ঝুঁকিতে বাংলা হরফের নির্ভরযোগ্য প্রকাশন ও মুদ্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন সংস্কৃত যন্ত্রনামের ছাপাখানার মাধ্যমে, যা সেদিনের নিরিখে এক বৈপ্লবিক উদ্যোগ। নিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংবাদপত্র সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ’-এর পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করেছেনবিদ্যাসাগরের আর একটি উল্লেখযোগ্য দূরদর্শী ও লোকহিতৈষী প্রয়াস হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফাণ্ডের (সমবায়িক ধরণের) পরিকল্পনা ও স্থাপনা এবং তার মধ্য দিয়ে পারিবারিক নিরাপত্তা ও আর্থিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা। যদিও এই সংস্থার সঙ্গে খুব বেশিদিন সংযুক্ত ছিলেন না তিনি, তবু সমবায়ভিত্তিক আন্দোলনের মত জীবনমুখি ও সমাজকল্যাণকর কর্মধারার পরিকল্পনা ও বাস্তব প্রয়োগ, দুয়েতেই তিনি সুদূরপ্রসারী ছাপ রেখে গেছেন।

তাঁর বহুধাবিস্তৃত কর্মকাণ্ডের এই সুবিপুল শ্রম ছাড়াও কলকাতায় ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্নতায় দর্শনার্থী, অর্থী-প্রার্থীর আসা যাওয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত বা বিশ্রামের কোনো সময় ছিল না। অবিশ্রান্ত কাজের চাপে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তির কিছুটা হয়তো দূর হত মাঝেমধ্যে জন্মভূমি বীরসিংহে গিয়ে ছোটোবেলার পরিবেশ ও আত্মীয়স্বজন সান্নিধ্যে। কিন্তু ১৮৬৯-এ বীরসিংহে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মনোমালিন্যে চিরকালের জন্য জন্মভূমি ছেড়ে আসা, তথাকথিত বহু শিক্ষিত মানুষের তঞ্চকতা, অভাবনীয় প্রতারণা, এই সবকিছু মিলে তাঁর মানসিক শান্তি ও শারীরিক অবস্থা দুয়েরই ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছিলএছাড়া ১৮৬৬-তে ঘোড়ার গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার পর তিনি কোনোদিনই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি

এমনই এক অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় ১৮৬৯-এর নভেম্বরে মা-কে লিখলেন, “পূজ্যপাদ শ্রীমন্মাতৃদেবী শ্রীচরণারবিন্দেষু প্রণতিপূর্ব্বকং নিবেদনম্‌- নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যেও সাংসারিক কোন বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোন সংস্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই। ...” এই বিষয়ে এর দু-সপ্তাহ পরে প্রায় একই বয়ানে পিতৃদেবকে লিখলেন “...সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি, কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি সে বিষয়ে কোন অংশে কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই।...” এরপর তাঁর প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি বীরসিংহে আর কখনও তিনি পদার্পন করেননি, যদিও ১৮৯১-এ তিরোধানের কিছু বছর আগে আবার বীরসিংহে যাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করলেও ব্যস্ততা এবং অসুস্থতার কারণে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অথচ সেখানে প্রতিষ্ঠিত যাবতীয় জনকল্যাণমূলক কাজের সুব্যবস্থা ও আর্থিক দায়ভার তিনি আজীবন, এমনকি মৃত্যু-পরবর্তী উইলেও বয়ে গেছেন।

যখন তাঁর শরীর মনের এমন অবস্থা, ডাক্তাররা হাওয়া বদলের পরামর্শ দিচ্ছিলেনস্বাস্থ্যকর নির্জন জায়গায় একটি বাসস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ খোঁজাখুজির পর ১৮৭৩- এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে মধুপুর আর জামতাড়ার মধ্যে কর্মাটাঁড়ে একটি পুরোনো বাড়িসহ তিন একর উনিশ শতক জমি কিনে তার ওপর নতুন করে, মনের মতো বাড়ি তৈরি করলেন, বাগান সাজালেন। নাম দিলেন নন্দনকানন’। উল্লেখ্য যে এসময়ের আগে থেকে তাঁর মা-বাবা বারাণসীতে গিয়ে সেখানে ছিলেন, যদিও এর দুবছর আগেই ১৮৭১-এ মা ভগবতী দেবী লোকান্তরিত হয়েছেন তবে কাশীর পরিবেশ তাঁর মনের অনুকূল ছিল না, বিশেষত সেখানকার বাঙালি ব্রাহ্মন সম্প্রদায়ের সংগে তাঁর মনান্তর সর্বজনবিদিত। তাই কলকাতার ক্লান্তি থেকে কর্মাটাঁড়ের অনাবিল সবুজ প্রকৃতি আর সাঁওতাল, কৃষিজীবি মানব প্রকৃতির মধ্যেই ছিল তাঁর ছুটি, এইই হয়ে উঠল তাঁর বাকি জীবনের বার্ধক্যের বারাণসী। আরও একটা কথা মনে করা দরকার যে জন্মভূমি বীরসিংহকে যাতে ভুলে না যান সে জন্য কলকাতাতেও তিনি নিজের কোনো বাড়ি এতদিন করেননিএরপরে বাবার অনুমতি নিয়ে ১৮৭৬-এ বাদুড়বাগানে আর একটি বাড়ি করলেনএই বাড়ি করার সিদ্ধান্তের প্রধান কারণ হিসেবে বাবাকে লিখেছিলেন, বারবার বাসাবদলে প্রাণপ্রিয় তাঁর ষোল হাজারেরও বেশি বিপুল বইয়ের সম্ভার-সম্পদের হারিয়ে যাওয়া, ক্ষতির কারণে তাদের একটি স্থায়ী বাসস্থানের দরকার হয়ে পড়েছেতবে কর্মাটাঁড় ছিল যেন বিদ্যাসাগর নামের ভারে চাপা পড়ে যাওয়া সহজ এক আন্তর ঈশ্বরচন্দ্রের খোলা হাওয়ায় মুক্তি। সেখানেও তাঁর প্রকৃতিগত মানবিকতার সমুজ্জ্বল প্রকাশ।

সমাজসংস্কার আন্দোলনকে বিদ্যাসাগর এক সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে দেখেছিলেনযথার্থ সংস্কার, যথার্থ বিপ্লব যা গঠনমূলক ও স্থায়ী, তার সফলতা অনায়াস বা দ্রুত আসে না। তাই একদিকে যেমন ছিল তাঁর সক্রিয় কর্মজীবনের স্বল্প সময়ে কার্যকরী করে তোলা যায় এমন অনেক উদ্যম তেমনই অন্যদিকে ছিল সমাজের সার্বিক সংস্কারে বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। কর্মাটাঁড়েও আমরা দেখি এই একই চিন্তাধারার প্রয়োগ

কর্মাটাঁড়ে বাড়ি করার পর একটানা খুব বেশি সময় তিনি সেখানে থাকতে পারতেন না, যেসব কাজের সূচনা তিনি করেছিলেন তার দায়িত্ব কর্তব্যে তাঁকে কলকাতা বা আরও অন্যান্য জায়গায় ফিরে ফিরে আসতে হত। তবু স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কর্মাটাঁড়ে মেয়েদের জন্য স্কুল, বয়স্কদের জন্য নৈশ স্কুল ও হোমিওপ্যাথি দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছিলেন। গরীব মানুষদের আশু প্রয়োজনগুলি তাঁর সাধ্যের বাইরে গিয়ে মেটানোর চেষ্টা করে গেছেন। কখনো তাদের বাড়িতে ডেকে প্রাণভরে খাইয়েছেন, কখনও তাদের না বিক্রি হওয়া ফসল কিনে নিয়ে, সেগুলি দিয়ে তাদেরই ক্ষুণ্ণিবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। যখন যার যা দরকার হয়েছে দিয়েছেন, যে যা আবদার করেছে সব মেটাতে চেষ্টা করেছেন কলকাতা থেকে এনেছেন প্রচুর শাড়ি জামাকাপড়, শীত বস্ত্র, নানারকম উপাদেয় খাদ্যসামগ্রী ছাড়াও উন্নত মানের বীজ১৮৭৫ সালে বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন কয়েকদিনের জন্য কর্মাটাঁড়ে গিয়েছিলেন। তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন: “তিনি প্রাতঃকাল হইতে বেলা দশ ঘটিকা পর্য্যন্ত, সাঁওতাল রোগীদিগকে হোমিওপ্যাথি-মতে চিকিৎসা করিতেন এবং পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি নিজ হইতে প্রদান করিতেনআহারাদির পর বাগানের গাছ পর্য্যবেক্ষণ করিতেন, আবশ্যকমতে একস্থানের চারাগাছ তুলাইয়া অন্য স্থানে বসাইতেন। পরে পুস্তক-রচনায় মনোনিবেশ করিতেন, অপরাহ্নে পীড়িত সাঁওতালদের পর্ণ-কুটীরে যাইয়া তত্ত্বাবধান করিতেন।” এটুকুতেই বোঝা যায় কর্মাটাঁড়েও স্বভাবসিদ্ধ ব্যস্ততায় কোনো ছেদ পড়েনি এই কর্মবীরের। এখানেও তিনি স্বচরিত্রে বিদ্যমান। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় তিনি যে শুধু বিশ্বাসী ছিলেন তা নয়, নিজেও যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। কর্মাটাঁড়ে তিনি বাড়িতে তো বটেই, দরকার হলে রোগীদের ঘরে ঘরে গিয়ে ওষুধ পথ্য দিয়ে তাদের সারিয়ে তুলেছেন

এই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রসারে তাঁর যা অবদান, তাকেও সাধারণের আয়ত্তাধীন এবং বিকল্প এক চিকিৎসা ভাবনার ক্ষেত্রে বলা যায় নবজাগরণের সামিল। ডাক্তার বেরিনি সাহেব কলকাতায় এসে যখন কিছুতেই সফল হতে পারছেন না, সেসময় বিদ্যাসাগরের অনুরোধে তাঁর সুহৃদ রাজেন্দ্র দত্ত মশায় বেরিনি সাহেবের কাছ থেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শেখেন। তবে তাঁর কাছেও শুরুতে কেউই চিকিৎসা করাতে চাননি, বিদ্যাসাগর মশায়ই প্রথমে নিজেকে সঁপে দিলেন এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির হাতে। তাঁর বেশ কিছু পুরোনো অসুস্থতা এতে সেরে যাওয়ায়, পরপর অনেকেই ভরসা করে ফল পেলেন। এরপর শুধু তিনি নিজেই শিখলেন তা নয়, রাজেন্দ্র বাবুর মাধ্যমে নিজের মেজো ভাই দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ছাড়াও আরও অনেককে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সুশিক্ষিত করে তুললেন। এভাবে বহু জায়গায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রসার হতে লাগল। বিদ্যাসাগর মশায়ের প্রেরণায় দীনবন্ধুবাবু বীরসিংহে এবং রাজেন্দ্রবাবুর আর এক ছাত্র কাশীতে গিয়ে যথেষ্ট পসার লাভ করেন ও নতুন ছাত্রদের তৈরি করতে থাকেন। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারও বিদ্যাসাগরের কথায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। নতুন কিছুকে পরীক্ষা করা, উপযুক্ত হলে তাকে সাগ্রহে বরণ করা ও জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এই ছিল তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথ। তাই তিনি অনুকরণীয়ভাবে চির প্রাসঙ্গিক ও চির আধুনিককর্মাটাঁড়ে তাঁর চিকিৎসার মাধ্যমেই বিহারে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেখানেও তিনিই পথপ্রদর্শক।

বিদ্যাসাগর ধর্মসংস্কারক ছিলেন না, ধর্মসংক্রান্ত কোনো নতুন মতবাদও তিনি প্রচার করেননি কিন্তু প্রতিটি ধর্মের যে মূল কথা, বহু সাধনে যা করায়ত্ত করার কথা বলা হয়ে থাকে, সেই নিঃস্বার্থ প্রেমভাব, পরার্থে উৎসর্গীকৃত সহজ নির্লোভ জীবনাচরণ ছিল তাঁর সহজাত। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর চরিত্রের এই রহস্য উন্মোচনে বিদ্যাসাগর জননীর মানবিক উচ্চতা সম্বন্ধে বলেন- “বঙ্গদেশের সৌভাগ্যক্রমে এই ভগবতীদেবী এক অসামান্যা রমণী ছিলেন। ... এই রমণীকে কোন শাস্ত্রের কোন শ্লোক খুঁজিতে হয় নাই; বিধাতার স্বহস্তলিখিত শাস্ত্র তাঁহার হৃদয়ের মধ্যে রাত্রিদিন উদ্‌ঘাটিত ছিল। অভিমন্যু জননীজঠরে থাকিতে যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়াছিলেন, বিদ্যাসাগরও বিধিলিখিত সেই মহাশাস্ত্র মাতৃগর্ভবাসকালেই অধ্যয়ন করিয়া আসিয়াছিলেন।” তাই তথাকথিত নিম্নশ্রেণী্র মহিলাদের রুক্ষ মাথায় নিজের হাতে তেল মাখিয়ে দিতে বা অন্য ধর্মের শিশুকে কোলে তুলে নিতে যেমন দুশো বছর আগের সমাজে বসেও এই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে একবারও বিন্দুমাত্র ভাবতে হয়নি, তেমনই কর্মাটাঁড়ে মেথরপল্লীতে গিয়ে কলেরা রোগগ্রস্ত মহিলার চিকিৎসা সেবা্র ভার নিজের হাতে তুলে নিতেও তাঁকে কিছুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হতে হয়নিতবু সেই তাঁকেও সমাজজীবনে বদল আনতে প্রচলিত শাস্ত্রবিধির শরণাপন্ন হতে হয়েছে কারণ তাদের কাছে তো সদ্‌যুক্তি আসল কথা নয়, যা শাস্ত্রে আছে তাই ধর্ম, তাই যুক্তি।’

বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে যুগধর্মের বিভিন্নতা সম্বন্ধে বহুবিধ বিশদ আলোচনা করেছেন এই অসামান্য শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত তাঁর বই দুটিতে প্রথম বইটিতে লিখেছেন, “কোন যুগে কোন ধর্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবেক, পরাশরপ্রণীত ধর্মশাস্ত্রে সে সমুদয়ের নিরূপণ আছে। পরাশরসংহিতার প্রথম অধ্যায়ে লিখিত আছে-

 

কৃতে তু মানবা ধর্মাস্ত্রেতায়াং গৌতমাঃ স্মৃতাঃ।

দ্বাপরে শাঙ্খলিখিতাঃ কলৌ পারাশরাঃ স্মৃতাঃ।।

 

মনুনিরূপিত ধর্ম সত্যযুগের ধর্ম, গৌতমনিরূপিত ধর্ম ত্রেতাযুগের ধর্ম, শঙ্খনিরূপিত ধর্ম দ্বাপরযুগের ধর্ম, পরাশরনিরূপিত ধর্ম কলিযুগের ধর্ম।”

 

দ্বিতীয় বইটিতে যুগধর্মের ভিন্নতা নিয়ে পরাশরসংহিতা থেকে একটি চমৎকার এবং বর্তমানকালেও প্রণিধানযোগ্য উদাহরণ-

 

কৃতে সম্ভাষণাদেব ত্রেতায়াং স্পর্শনেন চ।

দ্বাপরে ত্বন্নমাদায় কলৌ পততি কর্ম্মণা।।

সত্যযুগে সম্ভাষণ মাত্রেই পতিত হয়, ত্রেতাযুগে স্পর্শন দ্বারা পতিত হয়, দ্বাপরযুগে অন্নগ্রহণ দ্বারা পতিত হয়, কলিযুগে কর্ম দ্বারা পতিত হয়।অর্থাৎ ধর্মবিধির নিরিখে কলিযুগে কোনো সম্ভাষণ, স্পর্শ বা অন্নজল গ্রহণে নয় মানুষ স্বকর্মেই পতিত হয়। চারিত্রিক, মানবিক বা সামাজিক দুর্গুণবিশিষ্ট মানুষকে শাস্ত্রকাররা পতিতবললেনঅথচ এই শাস্ত্রনির্দেশের বিপরীতে আমরা ভ্রান্ত শাস্ত্রব্যাখ্যায় দ্বাপরযুগেই পরিত্যক্ত সেই ত্রেতাযুগের কথিত স্পর্শদোষদুষ্ট করে দিলাম নিরীহ অসহায় দরিদ্রদের!

কী মানবিকতায় কী শাস্ত্রজ্ঞানে আসল পতিত কারা সে বিষয়ে বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেনতঞ্চক, মিথ্যাচারী, কৃতঘ্ন সেইসব পতিতদের তাই তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন নির্দ্বিধায়অন্ত্যজ প্রান্তিকশ্রেণীর মানুষদের সংস্পর্শে এসে, নিজের হাতে সেবা করে সমাজের তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর মধ্যে আলোড়ন আনার সঙ্গে সঙ্গে, নিজেদের নীচু বলে এতদিন বিশ্বাস করে আসা মানুষদের মধ্যেও এনেছিলেন নবচেতনা, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আত্মবিশ্বাস। তাঁর নবজাগরণের প্রয়াস এভাবেই অব্যাহত ছিল তাঁর প্রিয় কর্মাটাঁড়েএখানেও বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবাবিবাহের উদ্যোগ, নৈশস্কুলের মাধ্যমে দিনমজুর গরীবদের মধ্যে শিক্ষাপ্রসার, ইত্যাদি তাঁর সেই নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসেরই সাক্ষ্য।

কর্মাটাঁড়ে আর একটি ব্যতিক্রমী কাজ, সাধারণ সাঁওতালদের উন্নত ধরনের চাষবাসে সচেতন করে তোলা। এখানকার কাঁকর মেশানো পাথুরে মাটিকে কিভাবে নন্দনকানন করে তোলা যায় তা তিনি শেখাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদের। নিজের বাড়ির বাগানে বড় গাছ ছাড়াও নানান মরশুমি শাকসবজি লাগাতেন, সাহায্যের জন্য ডেকে নিতেন সাঁওতাল শ্রমিকদের। অনুর্বর জমিতে কখনও কাঁকর বেছে, কখনও দরকারমতো কয়েক পরত মাটি খুঁড়ে ফেলে ভালো মাটি ঢেলে, ভালো মানের বীজ রোপণ করতেন। দ্বিগুণ পারিশ্রমিক, প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পুরো পয়সা- তাই কাজের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের শেখার উৎসাহেও ভাটা পড়ত না। ইংরেজ আমলে শহরায়ন বা রাস্তাঘাট তৈরির জন্য দ্রুত বনজঙ্গল কাটার ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ জঙ্গলের আদি নিবাসীদের জীবন জীবিকার মূলে টান পড়ে। চিরদিন বিনিময় প্রথায় অভ্যস্ত এই সব মানুষদের কাছে টাকা পয়সায় লেনদেন, ইংরেজ শাসন সবই নতুন। ফলে ইংরেজ ও তার সহযোগী জোতদার মহাজনদের খপ্পরে পড়ে ক্রমশ সর্বস্বান্ত হতে থাকে সরল এই মানুষগুলো। ১৯৫৫-৫৬-র সাঁওতাল বিদ্রোহ এরই ফল। ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতে প্রথম গণসংগ্রাম সেই আন্দোলনকে কী নারকীয়ভাবে পিষে ফেলা হয়েছিল তার ইতিহাস সকলের জানা। তারপরই গঠিত হয় দুমকা জেলা যা সাঁওতাল পরগণা নামে পরিচিতকর্মাটাঁড় তখন ছিল এই জেলাতেই, অধুনা জামতাড়া জেলায়ক্রূর ইংরেজের সঙ্গে লড়তে হলে যে প্রথমেই আধুনিক জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তাদের সমকক্ষ হতে হবে তা বুঝে ছিলেন বলেই, দেশীয় বিদ্যার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পাশ্চাত্য বিদ্যাও শিক্ষাসূচীর অন্তর্ভুক্ত করায় বিদ্যাসাগর আপসহীন ছিলেন। বন্দুক-কামানের মোকাবিলায় তীর-ধনুকে অমূল্য প্রাণের অপব্যয় না চেয়ে পরম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্থিতধী এই মানুষটি দেশের আদি নিবাসীদের সাংস্কৃতিক নিজস্বতা বজায় রেখে, মূল স্রোতের সঙ্গে অভিযোজিত করতে সচেষ্ট হলেন। বিদ্যালয়, আধুনিক চিকিৎসা, কৃষির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে এক নবজাগরণের সূচনা করলেন এইসব প্রান্তিক মানুষজনের মধ্যেও।

এত চেষ্টা সত্ত্বেও কর্মাটাঁড়ে তাঁর ভালোবাসার মানুষদের নিঃসীম দারিদ্র, দুঃখ-কষ্ট তিনি নির্মূল করতে পারেননি, এই নিষ্ঠুর বাস্তব তাঁকে কাঁদাত। শেষ বয়সে শরীর একেবারে যখন ভেঙে পড়েছে, কলকাতায় একজন তাঁকে কর্মাটাঁড়ে গিয়ে থাকার কথা বললে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “বাপু, সেখানে গেলে ভালো থাকি বটে। আমার যদি অতুল ঐশ্বর্য থাকত, তাহলে সেখানে গিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারতাম, শরীর-মন ভালো থাকত। কিন্তু, আমার সে অদৃষ্ট কই? আমার সে ক্ষমতা কই?... দ্যাখো, কার্মাটাঁড়ে একসের চালের ভাত, আধসের অড়হর ডাল, আধসের আলু আর একসের মাংস যে অনায়াসে খেতে পারে, তাকে আজকাল পোয়াটাক ভুট্টার ছাতু খেয়ে থাকতে হয়, তার বেশি আর জোটে না। আমি সেখানে গিয়ে দিব্যি খাওয়া-দাওয়া করব, আর আমার চারদিকে সাঁওতা্লেরা না খেয়ে মারা যাবে দেখব- এ কি সইতে পারি?” বলতে বলতে আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন দীননাথ সেই ঈশ্বর।

অন্যদিকে নিঃস্ব এই মানুষগুলো নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে তাদের নিখাদ ভালোবাসা্য ভরিয়ে রেখেছিল বিদ্যাসাগরকে। সেদিনের সেই কর্মাটাঁড়বাসীদের আমাদের হৃদয়ের স্বতোৎসারিত কৃতজ্ঞতা। যা আমরা দিতে পারিনি, তাঁরা তা নিজের অজান্তেই দিয়েছিলেন, ক্লান্ত শ্রান্ত বিদ্যাসাগরকে দু-দণ্ডের শান্তি। আর বিদ্যাসাগরের কাছেও আমরা আভূমি কৃতজ্ঞ, সাঁওতালদের কাছে নানাভাবে তাদের প্রবঞ্চিত করা বাঙালির মলিন ভাবমূর্তিটি তিনি তাঁর চরিত্রের সোনার ছটায় উজ্জ্বল করে তুলতে পেরেছিলেন। সাঁওতালদের কাছে বিদ্যেসাগরহয়ে উঠেছিলেন দেবতা। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসার এ এক অপরূপ দৃষ্টান্ত।

কেউ কেউ বলে থাকেন বিদ্যাসাগর শেষ বয়সে মানববিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন। এ বোধহয় কিছুটা খণ্ডিত দর্শন কিছু মানুষের স্বভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু মানবপ্রেমের আদর্শ থেকে কখনই তিনি এতটুকুও বিচ্যুত হননি। কর্মাটাঁড় বা তার বাইরের বলয়েও তাঁর জীবনচর্যা, মানবসেবা, সংস্কারকাজের প্রতিটি ঘটনায় তা বিধৃত। বাস্তবে তিনি মানবকল্যাণকর কোনও কিছু থেকে কখনোই সরে আসেননি, যা পরিণত বয়সে এসে সংসারে, সংস্কার কাজে জড়িয়ে থেকে তাঁর মতো মনীষীর পড়াশোনা কিছুই হল না এই অশ্রুসিক্ত আক্ষেপ থেকে স্পষ্ট হয়। বৃদ্ধবয়সে বিদ্যাসাগর একদিন মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের কাছে কাঁদতে-কাঁদতে বললেন- “আমার তো খুব ইচ্ছা ছিল যে পড়াশোনা করি, কিন্তু কই তা হল। সংসারে পড়ে কিছুই সময় পেলাম না।এমনতর মনোবেদনা উচ্চারণ করতে যে অতুলনীয় সারল্য ও নিরহংকার ব্যক্তিত্ব লাগে সেইই তো মহাসাগর- সেইই করুণাসাগর।

কোন প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে তাঁকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে জিততে হয়েছে তা বুঝতে বিদ্যাসাগর যে সময়ের কাণ্ডারি সেইসময়কার সামাজিক পটভূমি একবার দেখে নেওয়া প্রাসঙ্গিক হবেতিনি যখন পঞ্চাশ পেরিয়েছেন ১৮৭২-এর প্রথম নথিভুক্ত সরকারী সেই তথ্য অনুযায়ী ভারতে তখন মোট সাক্ষর নাগরিক প্রায় ৩.২৫% আর সাক্ষর নারী- আনুমানিক মাত্রই ০.৩০%। তাঁর তিরোধান সময়ে ১৮৯১-র পরিসংখ্যানে যা সামান্য বেড়ে মোট সাক্ষর প্রায় ৪.৬২%, আনুপাতিক হারে নারী- .৪২%, পুরুষ- .৪৪% আর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ১৯০১-সালে সাকুল্যে সাক্ষর ৫.৪০%, যার মধ্যে নারী- .৬০%, পুরুষ- .৮০%। তবে বাংলার নারীকুল তখনও সর্বভারতীয় সেই সীমায় পৌঁছোতে পারেনি, ১৯০১-এর বাংলায় সাক্ষর নারী- .৫০% ও পুরুষ- ১০.৪০%। সুতরাং তাঁর কর্মজীবনের মূলপর্যায়ে বাংলায় বা পুরো ভারতেই নারী সাক্ষরতার হার ০.২০% থেকে ০.৩০%-এর মধ্যে ধরে নেওয়া যায়। তাই বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন সেই সময়কালে, যখন নিরক্ষরতা দারিদ্র সমাজের মূল চালচিত্র। তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে ছিল অশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাকে অধিকার করে ফেলা মুষ্টিমেয় কিছু স্বঘোষিত সমাজপিতার বিধি-বিধানের দৌরাত্ম্যে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর সামাজিক অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ।

 

বিদ্যাসাগর আমাদের পথ দেখিয়েছিলেন সাম্যের, সামাজিক সন্তুলনের, সার্বিক উন্নয়নের; সে বীজ এতদিনেও আধুনিক মুক্তমনস্কতার উর্বর জমিতে পূর্ণ পল্লবিত হয়ে উঠল না কেন সে আত্মসমীক্ষা একান্ত প্রয়োজনআজকের সমাজেও ভাগ্যহত বিধবাদের, বিশেষত আর্থিক সঙ্গতিহীনাদের বিবাহ সাবলীল সামাজিক প্রথা হয়ে ওঠেনি। বাল্যবিবাহ যে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়েছে ঠিক তাও নয়। জাতপাতের অত্যাচার এবং নির্মম নিষ্ঠুরতা প্রতিদিনের খবর।

ব্রিটিশ-ভারতে যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও যুগান্তকারী এইসব সংশোধন আন্দোলনগুলি রূপায়িত হওয়ার শুরুর দিকে ১৯১১-সালে পুরো দেশে গড় সাক্ষরতা ছিল ৫.%, যার মধ্যে নারী ১.% এবং পুরুষ ১০.%। আর পুরো এক শতাব্দ পার করে ২০১১-তে সাক্ষর পুরুষ ৮২.% আর নারী ৬৫.%, এখনও এক তৃতীয়াংশ নিরক্ষরউপার্জনে মেয়েরা প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে এক শতাব্দ পরে, এই দশকে ২৫% মাইল-ফলকের কাছাকাছি এসেও, সংবাদপত্র তথ্য অনুসারে ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১৮-তে প্রায় ২১.%-তে এসে দঁড়িয়েছে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা, আইন প্রণয়নের পরেও আজ নারী পুরুষ জনসংখ্যা অনুপাত ৯৪০ : ১০০০অর্থাৎ শতাব্দব্যাপ্ত আধুনিকতা পার করে ১৯১১-সালের ৯৬৫ : ১০০০-এর তুলনায়, আজ তাদের অনুপাত আরও ২.% কম পুরুষ বনাম মেয়েদের শিক্ষার হার, উপার্জনে নজর কাড়া বৈষম্য, কন্যাভ্রূণ হত্যার কারণে জনসংখ্যায় ব্যাপক অসন্তুলন, ঊর্ধ্বগামী পণপ্রথা- পরিস্থিতি কিছু এমনই এখনও, এই একবিংশ মঙ্গলায়ন আধুনিকতার শতকেওমেয়ে বাঁচাও মেয়ে পড়াওআমাদের জাতীয় আন্দোলন  তাই আশ্চর্য মনে হয় না যে মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে অনিরাপদ দেশের তালিকায় প্রথম স্থানের কলঙ্কে নেমেছে ভারত। বিদ্যাসাগরের সেদিনের আক্ষেপ “... এই হতভাগ্য দেশে, পুরুষজাতির নৃশংসতা, স্বার্থপরতা, অবিমৃশ্যকারিতা প্রভৃতি দোষের আতিশয্যবশতঃ, স্ত্রীজাতির যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা অন্যত্র কুত্রাপি লক্ষিত হয় না।বা হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর, বলিতে পারি না!”- দুটি কথাই তাঁর দ্বিতীয় জন্মশতবর্ষে এসেও বহুলাংশে সত্য।

আমরা দেখেছি যখন যেখানে বিদ্যাসাগর, তখন সেখানেই নবজাগরণ, তিনিই ঋত্বিকতাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি আচরণে নতুন চেতনার উন্মেষ আর তাইই নতুন নতুন সামাজিক আন্দোলনের দিকনির্দেশতিনি হার্দিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ন্যায়ের দিশারী, উচ্চতম বিবেকের প্রতিভূ। তিনি তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন না, সমস্ত অর্থেই তাঁর জীবনই ছিল তাঁর বাণী। যা উচিত, যা কল্যাণকারী নিজের জীবনের একশো ভাগ দিয়ে তা তিনি করে গেছেনতাঁর সে যজ্ঞবহ্নি ধারণ করার, বহন করার দায়বদ্ধতা বাকিটুকু আমাদের।

আদ্যোপান্ত স্বদেশী গরিমায় উজ্জ্বল যোগীসুলভ সাদা উড়ুনি সাধারণ চটি পরা এই অসমসাহসী মানবদরদী এদেশে প্রথম আধুনিক মানুষটি আমাদের বুঝিয়ে গেছেন- আধুনিকতার, প্রগতিশীলতার প্রকৃত পরিচয় সামাজিক সাম্যের মমতাময় স্থিরসঙ্কল্পে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্পদ আহরণ এবং সাধারণ্যে তার বুনিয়াদ গড়ে তোলার দৃঢ়সিদ্ধান্তেদু-শতক প্রাচীন তিনি এখনও অনেকটাই এগিয়ে, তবে হাত বাড়িয়েই আছেন আমাদের দিকে। সেই হাত ধরার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়াতেই আমাদের উদ্বোধন, উত্তরণ।

 

তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা:

) বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ- বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি।

) চারিত্রপূজা : বিদ্যাসাগরচরিত- রবীন্দ্র রচনাবলী।

) বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস- শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন।

) কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর- ডাঃ প্রশান্ত কুমার মল্লিক।

) করুণাসাগর বিদ্যাসাগর- ইন্দ্রমিত্র।

বর্ণপরিচয়