বৃন্দাবন মন্ডলের গল্প - বিদ্যাসাগর এবং বিদ্যাসাগর

তিনি আছেন। তিনি আছেন বহুদিন ধরে শহরের প্রাণকেন্দ্র আলো করে। শীত গ্রীষ্ম ঝড় জল অভাব-অনটন তাকে টলাতে পারেনি। হয়তো একটু ক্ষয়ে গেছে মূর্তিটা, হয়তো ঠিক চেনা  যায় না। তবু শহরের মানুষ জানে তিনি আছেন। স্কুলে কলেজে কোর্টকাছারিতে যাবার সময় ব্যস্ততার মধ্যেও মানুষ একবার চেয়ে দেখে, হ্যাঁ, তিনি আছেন। বিশেষ বিশেষ দিনে মানুষ এসে জড়ো হয়। নিজেকে যাচাই করে, পরিশুদ্ধ করে নেয় তার সামনে দাঁড়িয়ে। আসলে মূর্তিটা আর মূর্তি নেই,  মূর্তি  ছাড়িয়ে মানুষটা মিশে গেছেন শহরের আকাশে বাতাসে মাটিতে। ছোট ছোট অসংখ্য প্রতিরূপ যেন খোদাই হয়ে আছে মানুষের অন্তরে অন্তরে। তিনি বিদ্যাসাগর! সেই উনবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে যার বর্ণপরিচয় হাতে নিয়ে বাঙালির বর্ণ পরিচয়। বাঙালীর বাঙ্গালীয়ানা, নবজাগরণের আলোকে পরিস্নান, উদারবাদের দীক্ষা,  গ্রহণশীলতা ও আন্তর্জাতিকতায় স্থিতি। সে বাঙালি আসলে বিশেষ কোনো মানুষের গোষ্ঠী মাত্র নয়; বাঙালিত্ব একটি ধারণা। এই সমস্ত  কিছুর প্রতীক হয়ে তিনি বিরাজ করছেন শহরের মাঝে।  কর্মযোগী  মানুষটি আজও অক্লান্ত। রোজ বিকেলে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়লে খর্বাকৃতি মানুষটির ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। সেখানে এসে আশ্রয় নেয় পাশের বস্তির কয়েকটি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। সমাজের দূরতম প্রান্তে আজও  শিক্ষার আলো পৌঁছে নি! বিদ্যাসাগর পাঠদান করে চলেন, অ আ ক খ। ঐক্য বাক্য মানিক্য। শিক্ষার আলোয় চকচক করে ওঠে শতাব্দী প্রাচীন ম্লান মুখগুলি।
      দিনমনি সূর্যের আবর্তনের ছন্দে দিন যায় বছর ঘোরে। একদিন বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব উপস্থিত হয়। লোকসভা নির্বাচন। দিন বদলেছে, সেদিনের সেইসব নিয়ম কানুন রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তন  জীবনের ধর্ম। এমনি একদিন ভোটের প্রচারে দুটি দল নেমে পড়ে শহরের অলিতে গলিতে। এখন গণতন্ত্রের প্রতীক হলো চেয়ার। অতএব যেন তেন প্রকারেন চেয়ার চায়। একদল বলল, এ শহর আমাদের। অন্য দল বলল, এ দেশ জনগণের। বচসা থেকে কথা কাটাকাটি, চুলোচুলি হাতাহাতি এবং শেষে লাঠি তলোয়ার বন্দুক। যারা এসব করছিল তারা কেমন যেন অচেনা ! হয়তো এই শহরেরই মানুষ, হয়তো বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। অথচ হাবভাব আচার আচরণে সে বাংলা কোথায়? মানুষ দ্বিধান্বিত। মূর্তিকে জিজ্ঞাসা করলো, বিদ্যাসাগর, এরা কারা? শুনে ওদের ছোখ মুখ বদলে গেল। আরে, এই বুড়ো কি তাহলে নির্দল থেকে দাঁড়িয়েছে? এ তো ভোট কাটবে! এই জন্যই মূর্তিটা নিয়ে শহরের মাতামাতি। অতএব ওটাকে ভেঙে ফেল। মুখ বাধা উদ্যত লাঠি তলোয়ার  রে রে করে লাফিয়ে পড়ল মূর্তিটার উপর। দমাদম কয়েকটি আঘাত দিতেই  পুরনো মূর্তিটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর শহর জুড়ে তাণ্ডবলীলা। কিন্তু দায় স্বীকার করল না কেউ। চলল পরস্পরকে দোষারোপ আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের প্রতিযোগিতা। মানুষগুলোর ভোট চাই তো।  মিটিং হল সভা হল; পদযাত্রা হল। একদল বলল, আমরা অষ্টধাতু দিয়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি বানিয়ে দেব, বৈদিক মন্ত্রে  প্রাণ প্রতিষ্ঠা করব। আরেক দল বললো,  আমরা কষ্টি পাথরের মূর্তি বানাবো যে মূর্তি কেবল দেবতারই হয়। আশ্চর্য! এত সব ঘটল অথচ শিক্ষিত সভ্য সমাজ সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ গড়ে তুললো না যেমনটা আগে হয়েছে বহুবার। আসলে সময় কোথায়? ছেলের জয়েন্ট, মেয়ের নাচ; এক সপ্তাহ বাদেই সিমলার টিকিট কাটা আছে। অবশ্য দু চারজন যারা কালো পতাকা হাতে পথে নেমেছিল শুরুতেই তাদের গলা চেপে ধরা হলো। ভোট উৎসব শেষ। নানান কৌশল অবলম্বনে এক দল জিতল, সংখ্যাতত্বের হিসেবে মেজরিটি। আর কে না জানে, জো জিতা ওহি সিকান্দার। অতএব তারাই মূর্তি নির্মাণের বাহুবলি। মহাসমারোহে মূর্তি নির্মাণ শুরু হল। সাড়ে চার ফুট মূর্তির জন্য সাড়ে চার হাজার গাড়ি ঘোড়া ছুটল; ছোট বড় অফিসার আমলা মন্ত্রী উঠে পড়ে লেগে পড়লো মূর্তি উৎসব পালন করতে।     
এখন কাঁচের ঘরে নিয়নের আলোয় সব সময় ঝকমক করতে থাকে মূর্তিটা। চারপাশ ঘিরে সুদৃশ্য উদ্যান। খবর ছোটে দিকে দিকে, ধন্য ধন্য পড়ে যায়। বিশেষজ্ঞ দল নিযুক্ত হয়, নুতন করে লেখা হয় বিদ্যাসাগরের জীবনী ও অবদান। দেশ বিদেশে থেকে প্রতিনিধি আসে এই মহান ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখতে। সরকারের মুকুটে শোভা পায় আন্তর্জাতিক সোনালী পালক।   বিদ্যাসাগর পরব  শেষ হলে জায়গাটা শান্ত হয়। একদিন ধীর পায়ে হেঁটে আসে  বস্তির সেই ছেলে মেয়ে গুলি। ছায়াটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বিজলি আলোয় ছায়া পড়ে না। ছেলেগুলি সে সব অগ্রাহ্য করে মূর্তির সামনে এসে দাঁড়ায়।
----- বিদ্যাসাগর, আমাদের লেখাপড়া শেখাবে না?  মূর্তিটা চোখ খোলে। তারপর বলে ওঠে, তোমরা কে? তোমাদের তো চিনি না।


No comments:

Post a Comment

বর্ণপরিচয়