চরণের ক্ষুদ্র দেহ পুড়িয়া ছাই হইতে বিলম্ব হইল না। কেশব
সেইদিকে চাহিয়া চাহিয়া সহসা ভয়ঙ্কর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল—সমস্ত
মিছে কথা! যারা কথায় কথায় বলে—ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য, তারা
শয়তান, হারামজাদা, জোচ্চোর!
বৃন্দাবন
দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ ঢাকিয়া অদূরে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল, ঘোর
রক্তবর্ণ শ্রান্ত দুই চোখ তুলিয়া ক্ষণকাল চাহিয়া দেখিয়া কহিল, শ্মশানে
রাগ করতে নেই কেশব।
প্রত্যুত্তরে
কেশব 'উঃ'–বলিয়া চুপ করিল।
ফিরিয়া
আসিবার পথে বাগদীদের দুই-তিনটি ছেলেমেয়ে গাছতলায় খেলা করিতেছিল, বৃন্দাবন
থমকিয়া দাড়াঁইয়া একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। শিশুরা খেলার ছলে আর একটা গাছতলায় যখন
ছুটিয়া চলিয়া গেল, বৃন্দাবন নিঃশ্বাস ফেলিয়া
বন্ধুর মুখপানে চাহিয়া বলিল, কেশব, কাল
থেকে অহর্নিশি যে প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে উঠেচে, এখন
বোধ করি তার জবাব পেলাম — সংসারের এক ছেলে মরারও প্রয়োজন আছে।
কেশব
এইমাত্র গালাগালি করিতেছিল, অকস্মাৎ এই অদ্ভুত সিদ্ধান্ত
শুনিয়া অবাক হইয়া রহিল।
বৃন্দাবন
কহিল, তোমার ছেলে নেই, তুমি হাজার চেষ্টা করলেও আমার
জ্বালা বুঝবে না — বোঝা অসম্ভব। এ এমন জ্বালা যে, মহাশত্রুর
জন্যও কেউ কামনা করে না। কিন্তু এর দামও আছে কেশব, এখন
যেন টের পাচ্ছি, খুব বড়-রকমের দামই আছে। তাই বোধ
হয়, ভগবান এরও ব্যবস্থা করেছেন।
কেশব
তেমনি নিরুত্তর-মুখে চাহিয়া রহিল; বৃন্দাবন বলিতে লাগিল, এই
জ্বালা আমার জুড়িয়ে যাচ্ছিল ওই শিশুদের পানে চেয়ে। আজ আমি সকলের মুখেই চরণের মুখ
দেখচি, সব শিশুকেই বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে হচ্চে — চরণ বেঁচে থাকতে ত
একটা দিনও এমন হয়নি!
কেশব
অবনতমুখে শুনিতে শুনিতে চলিতে লাগিল। পাঠশালার পোড়ো বনমালী ও তাহার ছোটভাই জলপান ও
জল লইয়া যাইতেছিল, বৃন্দাবন ডাকিয়া বলিল, বনমালী
কোথায় যাচ্ছিস রে?
বাবাকে জলপান দিতে মাঠে যাচ্ছি পণ্ডিতমশাই।
আমার
কাছে একবার আয় তোরা, বলিয়া নিজেই দুই হাত বাড়াইয়া
দিয়া উভয়কেই একসঙ্গে বুকের উপর টানিয়া লইয়া পরম স্নেহে তাহাদের মুখের পানে চাহিয়া
বলিল, আঃ — আঃ, বুক জুড়িয়ে গেল রে বনমালী! কেশব, কাল
বড় ভয় হয়েছিল ভাই, চরণকে বুঝি সত্যই হারালাম। না, আর
ভয় নেই, আর তাকে হারাতে হবে না—এদের
ভেতরেই চরণ আমার মিশিয়ে আছে, এদের ভেতর থেকেই একদিন তাকে
ফিরে পাবো।
কেশব
সভয়ে এদিকে-ওদিকে চাহিয়া বলিল, ছেড়ে দাও হে বৃন্দাবন, ওদের
মা কি কেউ দেখতে পেলে ভারী রাগ করবে।
ওঃ—তা
বটে। আমি চরণকে পুড়িয়ে আসছি যে! বলিয়া ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
বনমালী
পণ্ডিতমশায়ের ব্যবহারে লজ্জায় জড়সড় হইয়া পড়িয়াছিল, ছাড়া
পাইয়া ভাইকে লইয়া দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।
পণ্ডিতমশাই
সেইখানে পথের উপর হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া ঊর্ধ্বমুখে হাতজোড় করিয়া বলিল, জগদীশ্বর!
চরণকে নিয়েছ, কিন্তু আমার চোখের এই
দৃষ্টিটুকু যেন কেড়ে নিয়ো না! আজ যেমন দেখতে দিলে, এমনি
যেন চিরদিন সকল শিশুর মুখেই আমার চরণের মুখ দেখতে পাই। এমনি বুকে নেবার জন্যে যেন
চিরদিন দু'হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারি!
কেশব, শ্মশানে দাঁড়িয়ে যাঁদের গাল দিচ্ছিলে, তাঁরা
সকলেই হয়ত জোচ্চোর নন।
কেশব
হাত ধরিয়া বলিল, বাড়ি চল।
চল, বলিয়া
বৃন্দাবন অতি সহজেই দাঁড়াইল। দুই-এক পা অগ্রসর হইয়া বলিল, আজ
আমার বাচালতা মাপ করো ভাই। কেশব, মনের ওপর বড় গুরুভার চেপেছিল, এ
শাস্তি আমার কেন? জ্ঞানতঃ এমন কিছু গোহত্যা
ব্রহ্মহত্যা করিনি যে, ভগবান এত বড় দণ্ড আমাকে দিলেন, আমার—
কথাটা
সম্পূর্ণ না হইতেই কেশব উদ্ধতভাবে গর্জিয়া উঠিল, জিজ্ঞেস
কর গে ওই হারামজাদা বুড়ো ঘোষালকে—সে বলবে, তার জপ-তপের তেজে; জিজ্ঞেস
কর গে আর এক জোচ্চোরকে—সে বলবে, পূর্বজন্মের পাপে—উঃ—এই দেশের
ব্রাহ্মণ!
বৃন্দাবন ধীরভাবে বলিল, কেশব, গোখরো সাপের খোলসকে লাঠির আঘাত করে লাভ নেই,
পচা ঘোলের দুর্গন্ধের অপবাদ দুধের ওপর আরোপ করাও
ভুল। অজ্ঞান ব্রাহ্মণকেও কোথায় ঠেলে নিয়ে গেছে, তাই বরং দ্যাখো।
কেশব সেইসব কথা স্মরণ করিয়া ক্রোধে ক্ষোভে অন্তরে
পুড়িয়া যাইতেছিল, যা মুখে আসিল বলিল, তবে এতবড় দণ্ড কেন?
বৃন্দাবন কহিল, দণ্ড ত নয়। সেই কথাই তোমাকে বলছিলুম কেশব,
যখন কোন পাপের কথাই মনে পড়ে না, তখন এ আমার পাপের শাস্তি স্বীকার করে, নিজেকে ছোট করে দেখতে আমি চাইনে। এ জীবনে
স্মরণ হয় না, গত জীবনের ঘাড়েও নিরর্থক অপরাধ চাপিয়ে দিলে আত্মার অপমান করা হয়। সুতরাং
আমার এ পাপের ফল নয়, অপরাধের শাস্তি নয় — এ আমার গুরুগৃহ-বাসের গৌরবের ক্লেশ। কোন বড়
জিনিসই বিনা দুঃখে মেলে না কেশব, আজ আমার চরণের মৃত্যুতে যে শিক্ষা লাভ হল,
তত বড় শিক্ষা, পুত্রশোকের মত মহৎ দুঃখ ছাড়া কিছুতেই মেলে না। বুক চিরে দেখাবার হলে তোমাকে
দেখাতাম, আজ পৃথিবীর যেখানে যত
ছেলে আছে, তাদের সবাইকে আমার চরণ
তার নিজের জায়গাটি ছেড়ে দিয়ে গেছে। তুমি ব্রাহ্মণ,
আজ আমাকে শুধু এই আশীর্বাদ কর, আজ যা পেয়েছি,
তাকে যেন না হারিয়ে ফেলে সব নষ্ট করে বসি।
বৃন্দাবনের কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল, দুই বন্ধু মুখোমুখি দাঁড়াইয়া ঝরঝর করিয়া
কাঁদিয়া ফেলিল।
No comments:
Post a Comment