ভাষিক-সম্রাজ্যবাদ না একুশে ফেব্রুয়ারি: মহীদাস ভট্টাচার্য্য

 ভাষিক-সম্রাজ্যবাদ না একুশে ফেব্রুয়ারি

মহীদাস ভট্টাচার্য্য

যাদবপুর ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স এদেশে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করেছিল 1876-এ । গোটা ব্যাপারটি বঙ্গভাষীর কল্পনাপ্রসূত, তাঁদেরই অবদানে সমৃদ্ধ।  মহেন্দ্রলাল সরকার, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, গুরুদাস ব্যানার্জী, আশুতোষ মুখার্জী, চুণীলাল বসু,  সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী, প্রমথনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রমুখ বহু বঙ্গভাষীর শ্রম রয়েছে এখানে। সিভি রমন, মেঘনাদ সাহ-দের মতো বহু বিজ্ঞানী এই প্রতিষ্ঠানকে ও দেশকে গৌরবে ভূষিত করেছেন বিশ্বে। 

সেখানে ভারত সরকারের মিনিস্ট্রি অফ হোম এফিয়ার্স. ডিপার্টমেন্ট অফ অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে নির্দেশ এসেছে যে এই প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম হিন্দিতে করতে হবে। যেভাবে এসেছে তাতে বঙ্গভাষী হিসেবে অত্যন্ত বেদনাবোধ করি। কারণ তা বঙ্গভাষীর অবদানকে উদ্ধত্যের সঙ্গে উপেক্ষা করার বার্তা বহন করছে।  প্রশ্ন ওঠে -এই উদ্যোগ কেন? জ্ঞানানুশীলনে তো প্রতিষ্ঠানটির কোনো সমস্যা হয়নি এ যাবৎ। তবুও ভাষার ওপর আঘাত কেন? তাহলে কি নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি-২0-র প্রয়োগ শুরু হল?  কারণ সেখানে মাতৃভাষার উল্লেখ থাকলেও কৌশলে হিন্দি ভাষার আধিপত্য বিস্তারের নানা কৌশলী আয়োজন স্পষ্ট হয়েছে।  

বাংলাভাষা বহুদিন উপেক্ষিত থেকেছে বাংলায়, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও ইসলামী শাসনযন্ত্রের জাঁতাকলে অর্গলবদ্ধ হয়ে পড়েছিল । বাঙালীরা নিজেরাই অর্গল মুক্ত করেছে নতুন মনীষার আলোকে। কারুরই কোনো অবদান নেই সেখানে। বাঙালীর আত্ম-অনুশীলনের নিজস্ব সম্পদ তার ভাষা,  ভাবনা নতুন যুগের সংস্কৃতি। তার প্রতি এই উপেক্ষা কেন? 

এছাড়াও নির্বাচনের মুখেই এটি সামনে রেখে ঘোষণা কেন? বর্তমান রাজ্যে প্রশাসনিক জটিলতা আর লকডাউনের পরিকল্পনাও প্রবল। অন্যদিকে মোহগ্রস্ত বঙ্গসন্তানসন্ততিরা লাভলোকসানের বিলাসে ভেসে যুক্তিহীন নির্বাচনী রাজনীতির অলীক-কুনাট্যে এখন মজে আছে। রোড শো আর মারামারি আর কুতর্কে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার নয়তো? 

আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলায় এই ভাষানীতি প্রয়োগে সফল হলে শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য অনুসারে অন্যান্য সব মাতৃভাষাভাষীদের ওপর হিন্দির এই ভাষিক-সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসবে গোটা দেশে। এ চলতে দেওয়া যাবে কি? ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-র অকাল বোধন দরকার হবে না তো?  একদেশ, একভাষা, একধর্ম, একসরকার, একদল, একপ্রশাসন – এই সব পরিত্যক্ত নীতির বলি হবে কি সুনীতিবাবুর ভারতীয় জাতি-সত্ত্বার প্রধানভিত্তি – harmony of contrast. বৈসাদৃশ্যের ঐকতান?  গাইবো না কি ‘আ মরি মায়ের ভাষা ?’

6 comments:

  1. লেখকের নিজের মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ও আবেগ যথার্থ এবং যুক্তিসংগত। তবে আমার মনে হয় ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ অফিসিয়াল ল‍্যঙ্গুয়েজ থেকে আগত নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে লেখকের মনে অত‍্যন্ত বেদনাবোধের কোনও যুক্তিসংগত কারণ নাই। এই নির্দেশ ১৯৬৪ অফিসিয়াল ল‍্যঙ্গুয়েজ অ্যক্ট অনুসারে ভারত সরকারের সমস্ত সংস্থাতেই বাধ্যতামূলক ভাবে যাবে। বাংলার স্বনামধন্য মনিষীরাও বাংলাপ্রীতির সঙ্গে হিন্দি ভাষা কে স্বীকার করেছেন। আরও একটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে -ব‍র্তমানে এই সংস্থার কতটা অফিসিয়াল কাজ বাংলাভাষায় হয় থাকে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. একথাটি লেখকের জানা, অন্যান্য মনিষীদের মতোই, যে ভারত বহু মাতৃভাষার দেশ। ২০১১ হিসেবে অনুসারে দেশের শ্রেণী বিন্যস্ত মাতৃভাষার সংখ্যা ১৩৬৯। তাই ভাষা হিসেবে হিন্দি কেন, অন্তত কোন মাতৃভাষার প্রতি লেখকের বিরূপ মনোভাব নেই। প্রশ্ন হল ভাষা পরিকল্পনায় একটি মাতৃভাষার অন্য মাতৃভাষার খবরদারি করার জন্য মতো অসামঞ্জস্য কেন? ধরা যাক উত্তরপ্রদেশের ছাত্ররা হিন্দি আর ইংরেজি পড়ে নিজেদের যোগ্যতা অর্জন করবে অথচ একটি বাঙালি ছাত্র কে তিনটি ভাষা পড়তে হবে কেন? একটি সাঁওতালি ছাত্রকে সাঁওতালি বাংলা হিন্দি ইংরেজি চারটি ভাষা পড়তে হবে। বা ত্রিপুরার কোকবরক ভাষীদের কোকবরক বাংলা হিন্দি ইংরেজি পড়তে হবে কেন। অর্থাৎ দেশের কোনো নাগরিক দুটো ভাষা, কোন নাগরিক তিনটে ভাষা কাউকে চারটে কোথাও কোথাও কাউকে পাঁচটা ভাষা পড়তে হয়। সেগুলি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবেন না কেন? পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে সাহায্য করবে না কেন? এক দেশ এক ভাষার জাতীয় নীতি পরিত্যক্ত হয়েছে বহুভাষী দেশগুলোতে। অতীত থেকে ল্যাঙ্গুয়েজ পলিসিগুলোর কোনোটিই লেখক-এর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই যে নতুন শিক্ষানীতি হয়েছে সেখানে মাতৃভাষা মাতৃভাষা নাম জপতে জপতে কৌশলে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার যে পথ তৈরী করে দেয়া হলো শিক্ষানীতিতে, তা থাকবে কেন? ভাষাগুলি বিকাশের ক্ষেত্রে কি অতীতের সরকার বা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কেউই তেমন উদ্যোগ নেননি। কেন কৌশলে একটি বিশেষ ভাষাকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। সংবিধানের কথা বলবেন আপনি। সংবিধানে হিন্দি প্রমোট করার কথা বলা হয়েছে সংবিধানে কোথাও বলা নেই হিন্দি ইম্পোজ করার কথা।

      ঠিকই বলেছেন এই সকল সংস্থায় না বাংলাতে না হিন্দিতে গবেষণার কাজ তেমন করে হয়। তবে রাজ্যের প্রধান ভাষা সেখানে ঐতিহাসিকভাবেই চর্চিত হয়ে এসেছে। বেশিরভাগ লোকজনই বাংলায় চিন্তাভাবনা লেনদেন করেন। তাতেই তো প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুণমান অর্জন করেছে। আজ হঠাৎ এ নির্দেশ দিলেন কেন এর আগের কোন সরকার তো তেমন সিদ্ধান্ত নেননি। প্রশ্নটা সেখানেই। বাংলা ভাষার পরিচিতি যারা চান তারা কতখানি সরকারি এই সিদ্ধান্তকে প্রতিবাদে প্রতিফলিত করতে পারে যেটা খানিকটা জাতীয় শিক্ষানীতির অংশ সেটাকে যাচাই করার পরিকল্পনা যে নয় তাতো বলা যাবে না। আর এটাতে সফল হলে অন্য মাতৃভাষা গুলির ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়ে যাবেন কারণ প্রতিরোধ সেখানে গড়ে উঠবে না। তাই এই বিষয়টিকে বলবিকশিত হতে দেবে না সেই আশঙ্কা রয়েছে এখানে প্রধান। সেটি কোনো ভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এ দেশে জনগণের প্রয়োজন ও আকাংক্ষা অনুসারে বহুভাষিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে হবে, সকল ভাষার প্রতি আপেক্ষিক সমতার মনোভাব নিয়ে। ভাষার বিকাশ ও ব্যবহারের বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো ভাষার প্রতি কোনো বিশেষ উদ্যোগ কোনো ভাবেই কাংক্ষিত নয়। কালটিভেশান অফ সায়েন্সের এই সার্কুলারে সেই সঙ্কীর্ণতা ফুটে উঠেছে খানিকটা ঔদ্ধত্যের সঙ্গে। এতে হিন্দির বিরোধিতার প্রশ্নই নেই। প্রশ্ন ভাষা নীতি ও তার চালু করার রীতির প্রসঙ্গে।

      Delete
  2. দ্বিতীয় কমেন্টটি মহীদাস ভট্টাচার্য্যের।

    ReplyDelete
  3. হিন্দি ভাষা ভারতের রাষ্ট্রিয় ভাষা নয়। এটি অফিসিয়াল ল‍্যঙ্গুয়েজ অর্থাৎ রাজভাষা মাত্র। ভারত সরকারের সমস্ত সংস্থাতে রাজভাষা বিভাগ থাকা বাধ্যতামূলক। সংস্থা দ্বারা বিভিন্ন কার্যকলাপের কতখানি অংশ রাজভাষাতে করা হয় তা মুল‍্যায়ন করা এবং ক্রমশ যেন তাতে বৃদ্ধি হয় তার জন‍্য প্রোত্সাহন দেওয়া এই বিভাগের দায়িত্ব।
    তবে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া কখনই এই বিভাগের দায়িত্ব বা উদ্দ্যেশ্য নয়। এর প্রমাণ এই যে স্বাধীনতার ৭৫ বৎসর আর অফিসিয়াল ল‍্যঙ্গুয়েজ পলিসি আসার ৫৭ বৎসর পরও রাজভাষায় কাজ করা বাস্তবায়নের জন‍্য আমাদের প্রোত্সাহন দিতে হচ্ছে।
    লেখক যে চিঠির উল্লেখ করেছেন সে রকম চিঠি আদৌ স্থানীয় ভাষাকে অসম্মানের উদ্দেশ্য বা মনোবৃত্তি বহন করেনা। অহেতুক আশংকিত হবেন না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রথমত ওই পলিসিটিই একপেশে। তা যদি আরও দীর্ঘ সময়ের পরিসরে না আসে তাতে দেশের অগ্রগতি আটকাবে না। ঐ নীতি চালু হয়নি বলে দেশের বিকাশ আটকে আছে এমন তথ্য তো আমাদের হাতে আসে নি। আর অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজকে রাজভাষা বলা যায় কিনা সেটিও পুনর্বিবেচনার। কারণ ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলোতে ছোটো ছোটো রাজাদের দাপট রয়েছে ভালো। আর আপনি বলেছেন ওতে আর এমন কি আছে। কোনো বিষয়কে আমরা আমাদের মতো করে র্্যাশানালাইজড করতে পারি, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তখন কোনো বিষয় লাগু হয়, বা নিয়ম চালু হয় তখন একজন অফিসার বসে বসে করে যে ফেলেন না তা সেটি বোধ হয় অনুমান করতে পারবেন। এর ওপর একদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই পশ্চিমবঙ্গে এসে জেলার মোড়ে মোড়ে যখন জাতীয় শিক্ষানীতির বিষয়ে ওকালতি করছেন তখন এই প্রসঙ্গগুলোকে হালকা করে দেখি কি করে? এদেশের অ-হিন্দি ভাষীরা খানিকটা ঘর পোড়া গরু তো। ইতিমধ্যে যে সকল পদক্ষেপ নিচ্ছে ভাষানীতিতে আবার পিছু হটছে তা নতুন করে সিঁদুরে মেঘ যে জমছে সেটিই মনে করিয়ে দিচ্ছে। বারে বারে ওই কথা বাঙালীদের মনে করিয়ে দেয় Urdu and Urdu shall be the national language of Pakistan।

      Delete
  4. হিন্দি ভারতের অফিসিয়াল ল‍্যঙ্গুয়েজ তরজমা করলে "রাজভাষা" আর হিন্দি "রাষ্ট্রভাষা" অন্ততপক্ষে এখনও নয়।
    সমস্ত প্রান্তিক ভাষার নিজস্ব পরিচয় বজায় থাকবে তাই ভারতের সংবিধানে এই ব‍্যবস্থা।
    আরও বলি যে ভারতের অনেক ভাষার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধ সাহিত্য সম্ভার আছে। হয়তো রাজভাষা হিন্দির তুলনায় সেগুলির কয়েকটির সাহিত্যের ভাণ্ডার অনেক উন্নত এবং বিপুল , হতে পারে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই ভাষার স্বনামধন্য সাহিত্যিকরা স্বীকৃতি , প্রশংসা , পুরস্কার অর্জন করে দেশের খ‍্যাতিবৃদ্ধি তে যোগদান করেছেন। তবে এটিও ঠিক যে সর্বভারতীয় স্তরে হিন্দিই একমাত্র ভাষা যা বহুলসংখ‍্যক জনসমুদায় দ্বারা ব‍্যবহৃত। তাই কোন প্রদেশের পড়ুয়ারা যদি নিজেকে সর্বভারতীয় স্তরে প্রতীষ্ঠিত করতে চায় তাহলে সর্বভারতীয় ভাষা হিন্দি কে অগ্ৰাহ‍্য করা কাম‍্য নয় বরঞ্চ বলা বাহুল্য পড়ুয়াদের খানিকটা নিজস্ব স্বার্থেই হিন্দি ভাষা শেখা বাঞ্ছনীয়।

    ReplyDelete

বর্ণপরিচয়