'নজরুল স্মরণে' ~ড. আশিস্ কুমার সিংহ

'নজরুল স্মরণে'

  ~ড. আশিস্ কুমার সিংহ


পঞ্চম পর্ব       

  


নজরুল নিজের ব্যক্তিত্ব গঠন সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, "আগুন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃ‌ষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা -- এই অষ্টধাতু নিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্ছে, যা হবে দুর্ভেদ্য, মৃত্যুঞ্জয়, অবিনাশী।" এই কারণেই সময় ও সমাজ - সচেতন কবি লিখলেন, "আমরা এক‌ই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু - মুসলমান।" 


নজরুলের সাহিত্য - সৃষ্টির কালকে পন্ডিতজনেরা এক কথায় বাঙালির নিত্যকার জীবনে ও মানসে সঙ্ঘাত ও অস্থিরতার কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দেখা যাবে যে তখন সেই একদিকে যেমন  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জনিত ক্ষয় - ক্ষতি -- অবক্ষয় আর বিপর্যয়, সেই সঙ্গে আবার রাশিয়ার বিপ্লবের সাফল্য আর তার সঙ্গে এলো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিজেদের লক্ষ্য পথে এগিয়ে যাবার অদম্য জিদ। অন্য দিকে আবার বাংলা কংগ্রেসের গুটি - গুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়া, মুসলিম লীগের ক্রমশঃ শক্তিশালী হ‌ওয়া, সেই সঙ্গে সাম্যবাদের শুধু দানা বাঁধা‌ই নয় ক্রমশঃ শক্তিবৃদ্ধির দিকটাও জমাট বাঁধলো। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, আবার আগস্ট আন্দোলনের পদধ্বনিও ক্রমশঃ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠা আর সাম্প্রদায়িকতার ক্রমশঃ এগিয়ে যাওয়া -- এই সমস্ত ঘটনারাজি বাঙালির জীবনে এবং মনে একটা বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। এই কারণেই নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে এই সমস্ত ভাব - ভাবনার একটা স্বাভাবিক প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া লক্ষণীয় যে তৎকালে নজরুল‌ই আমাদের মাঝের একমাত্র প্রথম শ্রেণীর কবি  বা উপন্যাসকার যিনি কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। রুশ বিপ্লব ও সাম্যবাদে আপাদমস্তক প্রভাবিত কারাগার নির্যাতিত কবি লিখলেন, "নাহি - দেশ - কাল - পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে সব কালে, ঘরে - ঘরে, তিনি মানুষের জ্ঞাতি।" আবার ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণনগরে  বঙ্গীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী আসরে 'কান্ডারী হুঁশিয়ার' - এর রচয়িতা, মূল গায়ক ও সুরকার নজরুল লিখলেন, "হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কান্ডারী -- বলো, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র।" এখানে কবির শুভ বুদ্ধি কেবল নয়, প্রাসঙ্গিকতার দিকটিও যথারীতি লক্ষণীয়। তিনি বেদনার্ত হৃদয়ে দেখছেন, "গঙ্গা আছে, পদ্মা আছে -- কাবেরী আছে ও কৃষ্ণা আছে, কিন্তু সে মানুষ তো নেই।" এই কারণেই ১৮৯৯ সালের আমাদের সেই কবি আজকের এই ২০২১ - এতেও একেবারে নতুন -- এই কারণে তাঁর রচনায় প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছু নেই।


 শ্যামা সঙ্গীত রচনায় তিনি যতটা নিষ্ঠাবান ও একাগ্র, 'শাতিল আরব', আর 'মোহররমে'-ও তিনি ততটাই নিষ্ঠাবান ও একাগ্র। এই প্রসঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন,"নজরুল সেই বিরল অসামান্যদের একজন যাদের ঠিক একটা ছাপা চেহারায় চেনা যায় না। আমরা মূক বিস্ময়ে লক্ষ্য করবো যে "ঝড় হুল্লোড়ের সেনাপতি" যিনি একদিন ইংরেজ রাজপ্রাসাদের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, 'টর্পেডোর' - র সর্বনাশা ঝড়ে যখন রাজতন্ত্রের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম তখন সেই ১৯৪১ সালের ৫-৬ এপ্রিল কোলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতি হিসেবে নিজের জীবনের শেষ অভিভাষণে নজরুল বলেছিলেন, "আমাকে কেবল মুসলমান বলে দেখবেন না, আমি যদি আসি, আসবো হিন্দু - মুসলমান সকল জাতির ঊর্ধ্বে।" যিনি এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর দাস হয়ে, আমৃত্যু এই অন্তিম আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে নিয়ে জনসাধারণের কবি যিনি সৃষ্টির ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতা নিয়ে আমাদের মাঝে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, সেই কবির ওপার বাংলার ঢাকায় ২৯-এ আগষ্ট,  ১৯৭৬- এ দেহাবশান ঘটে। 


নজরুল নিঃসন্দেহে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন কিন্তু অধার্মিক ছিলেন না। তিনি হিন্দুদের পক্ষে কিংবা মুসলমানদের পক্ষে বলার জন্য নয়, তিনি সর্বত্রব্যাপী আলোর মতো মানুষের কথা বলার জন্য সাহিত্য আসরে অবতরিত হয়েছিলেন। চিরন্তন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত সত্য ধর্মে আস্থাশীল নজরুল সমস্ত শোষিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে লেখনী ধারণ করে , হতবাক হয়ে ভগবানের কাছে 'ফরিয়াদ' করেছেন, "জনগণে যারা জোঁক সম শোষে, তারে মহাজন কয় -- সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়। 

মাটীতে যাঁদের ঠেকেনা চরণ, মাটীর মালিক তাঁরাই হন -- যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ, সেই তত বলবান।" পরিশেষে 'আমার কৈফিয়ৎ'-এ কবির কৈফিয়ৎটুকু জানিয়ে আমি আমার এই লেখা শেষ করছি। কবি লিখেছেন,"রক্ত ঝরাতে পারিনাতো একা, তাই লিখে যাই এ রক্ত - লেখা।..... প্রার্থনা ক'রো -- যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।" নজরুল সেই রক্ত লেখার কবি।


অন্তিমে সমস্ত দিক পর্যালোচনা করে ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমরাও নজরুলকে বলতে পারি, "তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহৎ।"


'নজরুল - প্রণাম - পর্ব' - এবারের মতো এখানেই শেষ করলাম।


'গ্রন্থ - ঋণ' -

১. সঞ্চিতা - নজরুল ইসলাম

২. সাহিত্য - সঙ্গ - আবদুল       

     আজীজ আল - আমান

৩. নজরুল স্মৃতি - সম্পাদক :

     বিশ্বনাথ দে

৪. আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয় -  

     ড. দীপ্তি ত্রিপাঠী

৫. জ্যৈষ্ঠের ঝড় - অচিন্ত্য কুমার  

     সেনগুপ্ত

৬. নজরুল কাব্যগীতি : বৈচিত্র্য ও   

     মূল্যায়ন - ড. বাঁধন সেনগুপ্ত

৭. বিহার বাঙ্গলা অকাডেমি 

     পত্রিকা : নজরুল সংখ্যা 

1 comment:

  1. তথ‍্য সমৃদ্ধ লেখা, অনেক অজানা তথ্য জানলাম। লেখককে ধন্যবাদ

    ReplyDelete

বর্ণপরিচয়