আসামের ভাষা আন্দোলনের ’শিক্ষা ও আহ্বান': নীতীশ বিশ্বাস।

 আসামের ভাষা আন্দোলনের ’শিক্ষা ও আহ্বান'

 নীতীশ বিশ্বাস।

১৯৬১সালে আসামে জোর করে বাংলাভাষা কেড়ে নিয়ে অসমিয়া চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে ১৯শে মে বাংলা ভাষী বরাকবাসী সত্যাগ্রহ প্রতিরোধ আন্দোলনে সামিল হন।প্রবল জনজোয়ার ওঠে হাইলা কান্দী, করিমগঞ্জ ও শিলচরে । শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস সত্যাগ্রহীদের পরে নির্বিচার গুলি চলে। একদিনে ১১জন শহিদ হন। যারা হলেন বিশ্বর ভাষা আন্দোলনের প্রথম নারী শহিদ মাত্র ১৬বছর বয়সের কুমারী কমলা ভট্টাচার্য, ২০ বছরে ছাত্র শচীন্দ্রনাথ পাল,   ১৫ বছরের ছাত্র ও সামান্য স্টেশনারী  দোকানের মালিক সুনীল কুমার সরকার, সদ্য  বিবাহিত বীরেন্দ্র সূত্রধর;  রেলবিভাগের কর্মী ও বাম পন্থী ইউনিয়নের স্থানীয় নেতা কানাইলাল নিয়োগী, সাহসী,পরোপকারী আর ভয়ানক দরিদ্র, বয়ণ শিল্পী সুকমল পুরাকায়স্থ, দারুশিল্পী চন্ডী চরণ সূত্রধর, অবিবাহিত দেশপ্রেমিক যুবক  সত্যেন্দ্র দেব, উদ্বাস্তু জীবনের ঘূর্ণাবর্তে ত্রিপুরা হয়ে শিলচরে কাপড়ের দোকান-কর্মী হীতেশ বিশ্বাস, শৈশবে মাতৃহারা ও মামার চায়ের দোকানে সহকারী কুমুদ রঞ্জন দাস, এবং বয়ন সমিতির সম্পাদক তরণী দেবনাথ। এদের রক্তে রঞ্জিত পথে আসে ১৯শে মের সাফল্য। শেষ পর্যন্ত আসামে দ্বিতীয় রাজ্য ভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে পদে পদে চক্রান্ত চলতেই থাকে যা আজ বিজেপির মদতে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এখন বাঙালিকে তার ন্যুন্তম নাগরিক অধিকার পর্যন্ত হরণের সব ধরণের চক্রান্ত চলছে।যার বিরুদ্ধে চাই ভারত ব্যাপী বাংলা ভাষী ও গণতান্ত্রিক মানুষের  মহান ঐক্য ।

 এই প্রেক্ষিতে বলতে চাই  অনেক ‘মহান বাঙালি’ আমাদের  বাংলাভাষা প্রেমকে সংকীর্ণ ভাবেন। তারা ২০২১শে এসেও ভেবে দেখেন না, মায়ের ভালবাসাও বাইরের থেকে দেখলে সংকীর্ণ মনে হতেপারে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে যেমন দেশ-প্রেমকে অনেকে সংকীর্ণ বলেন।আজ যারা বাংলা দেশের সমর্থক তারা মুক্তি যুদ্ধের আগে কি বলতেন বা ভাবতেন মনে করুন। যা বুঝতে চান না  কেবল উদারতা নামক উদরাময় রোগাক্রান্ত ও দেশপ্রেমহীন কিছু  স্বার্থপর লোকেরা । তারা যখন ভাষা আগ্রাসনের সামনে পড়েন তখন যেনো তাদের কন্ঠে আর জোর  থাকে না । তাই আজও যে    বাংলা ভাষার জন্য কেন্দ্রের বাজেটে কোন বরাদ্দ নেই ; তাও কোন বাঙালি সাংসদের গলায় একটি শব্দ  ফোটে না। নিয়ম থাকলেও এন সি ই আর টির (NCERT)বই বাংলায় এই ৭০ বছরে  ছাপা হলনা । কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে নানা অজুহাতে  বাংলা পড়ানোর কোন ব্যবস্থাই হল না। রাজ্যে রাজ্যে বাংলা স্কুল উঠে গেল । আকাশবাণীর দিল্লী ও কলকাতা কেন্দ্রের বাংলায় জাতীয় খবর সম্প্রচার বন্ধ হোল। দূরদর্শনে হিন্দিতে অযুত চ্যানেল থাকা সত্ত্বেওকলকাতার দূরদর্শনের প্রাইম টাইমে নানা অজুহাতে প্রতি বছর বাংলা অনুষ্ঠান কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে । যারা এসব বিষয় জানেন তারা ব্যক্তিস্বার্থে কথা বলেন না । রবীন্দ্র-নজরুলের ঐতিহ্য বিরোধী দিল্লীর  নানা “ডেমি-পুরস্কারলোভী” তথা এই  মৌলোভীরাই  বাংলার বুদ্ধিজীবী কুলের উজ্জ্বল(!)তিলক। এই অবস্থায় আমাদের চোখের সামনে দন্ডকারণ্যের গোটা ৫০০ বাংলা স্কুল হারিয়ে গেল। বড় বড় শহরে বনেদী বাংলা স্কুলের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে থাকলেও বাংলা হীন সে সব বাংলা স্কুল বাঙালির প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।  আসামে ১৯শে মের যে অর্জন ছিল  তাও যে  নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে;  তা যেনো উচ্চারণেই পাপ। এমন কি রবীন্দ্র নাথের বিশ্বভারতীতেও বাংলা আজ পদে পদে  আক্রান্ত । কিন্তু কোন দলের মহান নেতারা যেনো  কিছুই জানেন না।  যেমন প্রথম হটাৎ দেওয়া লকডাউনের আগে   পরিযায়ী শ্রমিকের কথা মোদিজি ভুলেই ছিলেন। যেহেতূ বাঙালি ছাড়াও নানা ভাষীরা সে দলে ছিলেন  তাই মিডিয়ায় একটু শোরগোল হল ।কিন্তু   আন্দামানে সঠিক-জনসংখ্যার  ৬৪% বাঙালি হলেও সেখানের  প্রশাসনিক ভাষা ১৯৮৭থেকে হিন্দি হয়ে গেল।সেখানেও  বাংলাভাষা প্রায় নিশ্চিহ্ন।  ঝাড়খন্ডে ৪২% বাংলাভাষী হলেও একরাত্রির ফরমাণে বাংলা মাধ্যমের ৯০হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে হিন্দী মাধ্যমে ঠেলে দিলো বিজেপি সরকার।বাংলা স্কুল হীন এখন ওড়িষা থেকে উত্তরপ্রদেশ-এমনি ভয়াবহ সে অবস্থা সারা ভারতে । কিন্তু আমাদের বেদনা অন্যরাজ্যেই নয় এই বাংলায়ও এখন বাংলাচর্চা নিম্নমুখী।নতুন সরকার এসেই ব্লকে ব্লকে ইংলিশ (মূলত হিন্দি-ইংরেজি)স্কুল খোলার ঘোষণা দিলেন ।বললেন না বাংলা স্কুল গুলির পুরনো ঐতিহ্য ফিরিইয়ে আনার কথা। 

আসামে সাত দশক ধরে বাঙালি নিধন-নির্যাতন ও বিতাড়ন চলল, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ওখানের কত বামপন্থীরা প্রাণ দিয়েছিলেন । তার পরও বাংলার বনেদী সব পার্টি আর তার  মহাপ্রাণ নেতারা এই সংকীর্ণ বাঙালিরক্ষার রাজনীতি করতে এগিয়ে এলেন না ।আসলে তাদের কত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে  ভাবতে হয়,এসব তুচ্ছ বিষয় চর্চার সময় কোথায় ?!

 তাই ঐসব  হৎভাগ্য ভাই বোনের কথা  আমাদেরর মনেও আসেনা । আর ভোট–সর্বস্ব রাজ নৈতিক দলগুলি দেখলো এদের তো এখানে ভোট নেই, এসব সর্ব ভারতীয় অবান্তর  বিষয়ের দায় তো সর্ব ভারতীয় কমিটির বা কেন্দ্রীয় কমিটির। আর সে সব কমিটির বাঙালি সদস্যরা এতোই দলানুগত যে এই সব সংকীর্ণ ইসু তোলার মতো ‘মূর্খ-সদস্যের অভাব হইল’।শুধুকি তাই  কলাটা মূলোটার উজ্জ্বল চেহারা দেখে  সে সব   কথা বলার যেনো মনোবলই তারা পেলেন না ।তাই রাজ্য ও কেন্দ্রে বাংলা ভাষা ও বাঙালিরাই ভারতে আজ সবচাইতে অবহেলিত।কবির ভাষায়,“বাংলা ভাষা জননী, তুমি  এদেশে সন্তান হীনা” ।

  ভারতে অধিকাংশ রাজ্যে সেই সেই  রাজ্যের প্রধান ভাষা স্কুলস্তরে আবশ্যিক ।কেবল বাদ এই রাজ্য। সম্প্রতি কেরলও তা করল। কিন্তু আমাদের বিধায়ক-সাংসদেরা অধিকাংশই  সেসব তথ্য সঠিকভাবে  জানেন না। আর  তারা জানেন না নিজেকে ছাড়া  কাকে ভালোবাসেন সে কথাও। নিজের কেরিয়ারের জন্য তারা আন্তপার্টি সংগ্রাম করে তার ন্যায্যদাবি বের করে আনার মতো  তাত্ত্বিক ও তাথ্যিক শক্তিধর  নন অথবা ব্যক্তি স্বার্থে সে  ইচ্ছেও  তাদের মনে হয়তো আসে না । না হলে সোমনাথ  লাহিড়ী ১৯৬৩ সালে বিধান সভায় যে দাবি করতে পারেন তা এযুগের  কোনো দলের কোনো নেতা তা তুলতে পারেন না ? এমন কি, “ ২০১৭ সালের ১২ই মে ( সামনে ১৯শে মে ছিলো, আর আমাদের মতো সংগঠন সমূহের লাগাতার দাবিতে)  মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন অবিলম্বে রাজ্যের সব মাধ্যমের( হিন্দি-ইংরেজি সহ )বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একটি বিষয় আবশ্যিক ভাবে বাংলা করা হল ”। আমরা আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি পার্বত্য জেলা পরিষদ বাদে এই আইনের নির্দেশিকা  প্রকাশ করা হোক। কিন্তু মাননীয়া কিভাবে আর কেনো যে সে সব ভুলে গেলেন তা আজও জানিনা । আর বিরোধীরা রাজ্যের সার্বিক স্বার্থে  নানা ইসুতে নবান্নে গিয়ে পর্যন্ত সমর্থন দিয়ে আসেন, এক্ষেত্রে এই হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান জিগিরের বিরুদ্ধে কেনো মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা কার্যকরী করার জন্য সেদিন তারা দাবি জানালেন না ? 

 শাসক ও বিরোধী দলের সবাইকে আবেদন অবিলম্বে  রাজ্যের সম্প্রীতির সার্বিক স্বার্থে  আমাদের  দাবিগুলি গ্রহণ করুনঃ ১। স্বশাসিত জেলা বাদে রাজ্যের প্রধান ভাষা বাংলা আবশ্যিক ভাবে সমস্ত ধরনের স্কুলে পাঠ্য করতে হবে. ২। কেন্দ্রীয় স্কুল সহ কেন্দ্র-অনুমোদিত সমস্ত স্কুলে বাংলা পড়ানোর সুযোগ দিতে হবে।৩। রাজ্যের সমস্ত কেন্দ্রীয় দপ্তরে এমন কি বেসরকারী দপ্তরে এরাজ্যের বাংলা জানা প্রার্থীদের চাকুরি দিতে হবে।৪।সাইন বোর্ডসহ সমস্ত জনসংযোগের  কাজে বাংলা আবশ্যিক করতে হবে। ৪। রাজ্যের চাকুরি ও জয়েন্টের সমস্ত পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র  বাংলায় দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।৫।রেডিও- টিভিতে বাংলা-অনুষ্ঠানের সময় বাড়াতে হবে। ৬। দিল্লীসরকারের  মতো রাজ্যের সমস্ত সরকারী  স্কুলের উন্নতি বিধান করতে হবে। কোন অজুহাতে বাংলাস্কুল বন্ধ করা চলবে না।                                                                               তবে আমরা পরিস্কার ভাবে একথা বলতে চাই যে, সারা রাজ্যে বিশেষ করে যে ভিন্ন রাজ্যের ও ভিন্নভাষী যারা আছেন তাদের  এরাজ্যে শান্তিতে থাকার ও  সম্প্রীতির বাতাবরণ জোরদার করার পক্ষে আমরা । তবে  গুজরাট থেকে কাশ্মীরী (পশ্চিমা) ধনিক রাজনীতিকদের  চক্রান্তে দেশভাগের নিষ্ঠুর-বলী বাঙালি, তাদের নাগরিকত্বের নামে বিজেপির অত্যাচার বন্ধ হোক।, রবীন্দ্র-নজরুলের ভাষা তথা পৃথিবীর ৪র্থ ভাষার  পক্ষেআমরা ।আমাদের  সমাজ জীবনের ভাষা হোক বাংলা।   ভাষার ক্ষেত্রে আমরা  অন্য কোন  ভাষা বিদ্বেষী নই । আমাদের ঐতিহাসিক  ডাক ," নিজের মাতৃ ভাষাকে ভালবাসো, আর অন্যের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা কর।"-আমরা সেই পথেই চলছি। আপনিও স্বাগত।১০৭৭শব্দ ।

 *সম্পাদক,সর্ব ভারতীয় বাংলা ভাষা মঞ্চ, সহমর্মী, ঐকতান গবেষণা পত্র Ph: 9330961824  ।

No comments:

Post a Comment

বর্ণপরিচয়