সারা ভারতে বাঙালি উদ্বাস্তু ও বাংলাভাষীদের অধিকার আদায়ের জন্য আত্ম-প্রস্তুতি ও দাবিপত্র

সারা ভারতে বাঙালি উদ্বাস্তু ও বাংলাভাষীদের
অধিকার আদায়ের জন্য আত্ম-প্রস্তুতি  দাবিপত্র    নীতীশ বিশ্বাস

        সারা ভারতের বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রধান সমস্যাগুলি এখন আমাদের সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা দরকার। যেমন ২০০৩ সালের পরে তার কেন্দ্রবিন্দুতে বিরাজ করছে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি। তার আবার চরিত্রের দিক থেকে আসামে যেমন, সারা ভারতে তা নয়। কারণ ব্রিটিশ শাসকদের চক্রান্তে আর বাংলার বর্ণবাদীদের অগণতান্ত্রিক আচরণের ফলে বাংলার অন্যান্য প্রতিবেশি রাজ্যের মতোই আসামের সঙ্গেও আমাদের সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। তার উপর অসমিয়া জাত্যভিমানী সংস্কৃতির হীনম্মন্য আক্রমণে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি ঐ অঞ্চলে দীর্ঘ দিন আগে থেকেই আক্রান্ত ও রক্তাক্ত। তবে সেখানে নতুন শাসন প্রবর্তনের পর এই সমস্যা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। নাগরিক পঞ্জি নবিকরণের (NRC) নামে এক জ্বলন্ত অভিশাপ নেমে এসে যে ১৯ লক্ষ অনসমিয়াকে বেনাগরিক ঘোষণা করেছে, তার প্রায় ১২ লক্ষ হল দলিত বাঙালি উদ্বাস্তু। এই নাগরিকত্বের নথি প্রদানের একুশে-আইনের ধাক্কায় যে মানুষ গুলোর পরিবার ভেঙ্গে তছ-নছ হয়ে গেছে তাদের অধিকাংশই দলিত ও দরিদ্র মানুষ। অর্থাৎ আমরা স্বাধীনতার ৭ দশক পরেও নাগরিকত্বের নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। সংবিধানের কোন অধিকারের অধিকারী আমরা নই। তাই কেবল মাত্র পশ্চিমবঙ্গে আসা উদ্বাস্তুদেরই ২০টি প্রদেশে সতীর ছিন্ন দেহের মতো ছুঁড়ে-ফুঁড়ে ফেলা হল। তার না আছে সঠিক জমির বরাদ্দ, না গৃহের ব্যবস্থা, না স্বাস্থ্য, শিক্ষা। বিশেষ ভাবে তারা সারা দেশে আজ মাতৃভাষা ও মাতৃসংস্কৃতি হারা। এমন কি নেই তাদের জাতি প্রমাণ পত্র। তার ওপর, রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন ধরণের দলিত নেতা ও রাজনৈতিক দল এমন কি অরাজনৈতিক গ্রুপ বা NGO গুলিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাঙালি দলিতদের জাতি প্রমাণ পত্র দেওয়ার বিরুদ্ধে। লজ্জার কথা তারাও আম্বেদকর বাদী কিন্তু বাঙালি বিদ্বেষী। কিন্তু সারা ভারতের সব আম্বেদকরবাদীই জানেন যে ১৯৪৬ সালে যুক্ত বাংলা থেকে বাবা সাহেবকে নির্বাচিত করেন মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের নেতৃত্বে বাংলার দলিত সদস্যরা (যাদের মধ্যে ছিলেন ২। ফরিদ পুরের কংগ্রেস সদস্য দ্বারিকানাথ বারুরি, ৩। কুমিল্লার গয়ানাথ বিশ্বাস, ৪। রংপুরের ক্ষেত্রনাথ সিঙ্ঘ, ৫। রংপুরের নির্দল সদস্য নগেন্দ্রনারায়ন রায়, ৬। মুর্শিদাবাদের আদিবাসী সদস্য বীর বীরশা, ৭। খুলনার মুকুন্দ বিহারী মল্লিক।) কিন্তু এই এদের বংশধরদেরই বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র স্বার্থে রাজ্যে রাজ্যে এই বিশ্বাসঘাতকতা। আর তাদের নেতা নেত্রীরাই পশ্চিমবঙ্গের নানা সভা-সমাবেশে বন্ধুবেশে হেসে হেসে গা-ঘেঁসে ঘেঁসে বাঙালি প্রেমের বাণী বিতরণ করেন। এই ট্রাজিডির মধ্যে আমরা আধ-মরা অবস্থায় বেঁচে আছি। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে গেলে আমাদের সারা দেশে প্রথমে মাতৃভাষার ন্যূনতম অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন করতে হবে। এটা ঠিক যে প্রশাসনে যে ভাষার অধিকার থাকে না সে ভাষা পড়ার আগ্রহ ছাত্র-ছাত্রীদের বা অভিভাবকদের থাকেনা। কিন্তু যারা সামান্য দূরদৃষ্টি সম্পন্ন তারা বুঝবেন যে একটা নলকূপ স্থাপনের জন্যও প্রথমে একটা করে স্তর অতিক্রম করতে হয় তার পর সে নলকূপ থেকে আসে আরো নানা প্রয়োজনের অজস্র জলধারা। আগে সারা ভারতে আমাদের ছিল শহরে ও উদ্বাস্তু গ্রামে গ্রামে বাংলা স্কুল। এখন আমরা আর বাংলা মাধ্যমের স্কুল চাইনা। কারণ আন্দামান (৬৪% বাংলা ভাষী), ঝাড়খন্ড (৪২% বাংলা ভাষী) বা আসাম (৩৬% বাংলা ভাষী) ছাড়া সে বাস্তব পরিস্থিতি আর নেই। সে যাই হোক আন্দোলন করলে যে কিছু ফল আসে তার প্রমাণ কর্ণাটক, বিহার এবং মহারাষ্ট্রের কিছু পকেট। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে  আমাদের নিচের তথ্যগুলি সংগ্রহ করতে হবেঃ 

লোক সংখ্যা – 
 
১।। রাজ্যে কোন কোন অঞ্চলে বাঙালি/উদ্বাস্তু বাঙালিরা কত পরিমাণ বসবাস করেন? তার আবার জেলা বা অঞ্চল ধরে ধরে সংখ্যা। এই জন সংখ্যা কিন্তু লোক গণনার নথি থেকে ধরা যাবে না। নিতে হবে অঞ্চল ভিত্তিক ভোটার লিস্টের পদবি বা গ্রামের বাসিন্দাদের জানা তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে। তাই একাজ যেকোন সাধারণ গবেষক/সমীক্ষক পারবেন না। চাই এলাকা-বিশেষজ্ঞ মানুষ। 

স্কুল সংখ্যা –

২।ক। ঐতিহ্যপূর্ণ পুরনো স্কুল কোথায় ছিলো? তার নাম সাল এককালের ঐতিহ্য। এবং এখন তার স্মৃতি কতটুকু আছে কি ভাবে? বাংলা বাস্তবতঃ পড়ানো হয় কিনা? 
২।খ। উদ্বাস্তু গ্রামে গ্রামে এক বা একাধিক স্কুল গড়ে উঠেছিল। কত দিন পর্যন্ত  বাংলা মাধ্যম ছিলো? শিক্ষক ছিলো কিনা? কিভাবে তার মৃত্যু হল ? – এখন সেখানে কি স্কুল আছে? বা শেষ কি অবস্থা ? 
অন্য স্কুল – 
৩। ক।। অন্য কোন কোন স্কুলে এক বিষয়ও বাংলা পড়ানো হোত? কত সাল থেকে কতো সাল অবধি? এখন বাঙালি ছেলে মেয়েরা বাংলা পড়তে পারে কি? চায়কি ? 
৩।খ।। বাংলা বইপত্র কিছু আছে কি ? 
৩।।গ।। পশ্চিমবংগ কোন কালে বই দিতো কি ? কত বই ? কবে বন্ধ হল?
 
আমাদের দাবিঃ 

        প্রত্যেক অঞ্চলেই নিজ নিজ পরিস্থিতি অনুসারে দাবিগুলিও একটু একটু ভিন্ন তর হবে। তার ভিত্তিতে আমাদের রাজ্যে রাজ্যে আলাদা দাবিপত্র প্রস্তুত করতে হবে। সেই দাবিপত্র নিজের রাজ্যের জন্য সেই রাজ্যের বন্ধুদের করতে হবে। এ সব দাবির প্রায় সিংহ ভাগ রাজ্যে কাছে করতে হবে। 
কেন্দ্রীয় দাবি। 
১।ক। দন্ডকারণ্য প্রকল্পের অধীন যত স্কুল ছিলো, তার অধিকাংশই বাংলা মাধ্যম  ছিলো। সেই ভৌগলিক অঞ্চল বৃত্তে একটি বাংলা শিক্ষা-উপনিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তার বাজেট NCERT/ SCERTর মাধ্যমে বরাদ্দ হতে পারে। 
খ। দন্ডকারণ্য বা যেসব ট্রান্সিট ক্যাম্পের থেকে নানা স্থানে উদ্বাস্তুদের নানা অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে, সেখানেও বাংলা পড়ানোর জন্য কেন্দ্র সরকারকে বাজেট বরাদ্দ রাজ্যকে বা NCERT/SCERT কে দিতে হবে। 
২।ক। ঐতিহ্যবান বাংলা স্কুল/সংস্কৃতি কেন্দ্র/ধর্মস্থান ও ক্রীড়া কেন্দ্র বা খেলার মাঠগুলি সংস্কার ও উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। 
খ। বিশিষ্ট বাঙালি প্রতিষ্ঠান ও মহাজনদের গৃহ বা আশ্রম/শশ্মান ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে।

No comments:

Post a Comment

বর্ণপরিচয়