আনন্দবাজার পত্রিকা: অনলাইন সংস্করণ: ৪ ভাদ্র ১৪২৭, বৃহস্পতিবার: ২০ অগস্ট ২০২০: ই-পেপার থেকে সংগৃহীত

 

৪ ভাদ্র ১৪২৭, বৃহস্পতিবার: ২০ অগস্ট ২০২০: ই-পেপার

তাড়ার অর্থ

নূতন শিক্ষানীতি ঘোষণা করিয়া সরকার জানাইয়াছিল, তাহার প্রয়োগে বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়া নাই। তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনও অজ্ঞাত কারণে মত পাল্টাইলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক। যথাসম্ভব দ্রুত এই নীতি কার্যকর করিবার জন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি আহ্বান করিয়াছেন তিনি। এহেন তাড়া বিস্ময়কর, বিপজ্জনকও বটে! বর্তমানে করোনাভাইরাস-জনিত অতিমারির দাপটে দেশে রীতিমতো জরুরি অবস্থা জারি, যাহার অন্যতম প্রধান শিকার শিক্ষাব্যবস্থা। প্রতিটি স্তরে লেখাপড়া স্তব্ধ। আগামী এক বৎসরে তাহার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াইবে, কাহারও নিকট স্পষ্ট নহে। ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সরকার সকলেই দিশাহারা। বাদানুবাদ চলিতেছে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের ভিতর, যাহা সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াইতেছে। সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষার তারিখ পর্যন্ত এখন তীব্র সংঘাতের বিষয়। সর্বস্তরে লেখাপড়াই যেখানে এই ভাবে থমকাইয়া, তেমন সময়ে গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বুনিয়াদি নীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত? এই মুহূর্তে নিকট ভবিষ্যৎই অনিশ্চয়তার অতল জলে, তাহার মধ্যে দাঁড়াইয়া দূর ভবিষ্যতের শিক্ষা-কাঠামো তৈরি? কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্যাখ্যা করিয়াছেন, দেশের স্বার্থে সংস্কার চালু করিবার বিষয়ে আর বিলম্ব চলিবে না। প্রশ্ন উঠিবে, কিসের স্বার্থ? কাহাদের স্বার্থরক্ষার কথা ভাবিতেছে সরকার? বিপদগ্রস্ত সময়ে বিপদের মীমাংসা না করিয়া তাড়াহুড়া করিয়া নূতন নীতির প্রয়োগই দেশের স্বার্থরক্ষার প্রকৃষ্ট উপায়এমন ছেলেভুলানো বাক্য কাহাকে শুনাইতেছেন মন্ত্রিবর? দেশের নাগরিককে কি তাঁহারা অবোধ শিশু ভাবেন?

বিষয়টি বিপজ্জনক এই জন্য যে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি লইয়া নানাবিধ আশঙ্কা ও আপত্তি উপস্থিত হইয়াছে, যাহা সমগ্রত রাজনৈতিক বিতণ্ডাবলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। নূতন শিক্ষানীতি ও তাহার প্রয়োগ লইয়া বিভিন্ন রাজ্য হইতে প্রতিবাদ ও সংশোধনের দাবি ধ্বনিত হইতেছে। পশ্চিমবঙ্গ তাহার অন্যতম। প্রসঙ্গত, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সহিত আলোচনা করিয়া নীতি প্রস্তুত হইলেও সেই কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গের কেহ ছিলেন না। ইহার পরে রাজ্য লিখিত বক্তব্য প্রেরণ করিলেও তাহা অগ্রাহ্য করা হইয়াছে। ভারতীয় সংবিধানমতে, শিক্ষা কিন্তু যৌথ তালিকার অন্তর্গত, এখনও। তবে কী রূপে একটি রাজ্যের বিশেষজ্ঞদের মতামত বিনা সেই রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা তৈয়ারি হয়? কেন রাজ্যের মতামত গ্রহণ না করিয়া কেন্দ্র একক সিদ্ধান্ত লয়? কেন্দ্রীয় নীতি ঘোষিত হইবার পর একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করিয়াছিল রাজ্য। আপত্তির স্থানগুলি চিহ্নিত করিয়া কেন্দ্রের নিকট রিপোর্ট পাঠাইয়াছিল। কিন্তু আপত্তি না শুনিয়াই যদি নীতি প্রযুক্ত হয়, তবে সকল পদ্ধতি, সকল কমিটিই অর্থহীন।

নীতি ঘোষণার সময়েও তাড়াহুড়া বড় কম ছিল নাসংসদকে এড়াইয়াই এত বড় সংস্কার প্রণীত হইয়া গেল। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাড়াহুড়ার পিছনে প্রণোদনাটি ঠিক কিসের? শাসক দলের কিছু হিসাব মিলাইবার প্রয়োজন? কী সেই হিসাব? এই মুহূর্তে তাহাদের সম্পাদ্য কার্যাবলির অন্যতম হিন্দি ভাষার প্রচার-প্রসার। নূতন নীতির রূপরেখা দেখিয়া বহু রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, সরাসরি না হইলেও পিছনের দরজা দিয়া সমগ্র দেশে হিন্দি চাপাইয়া দিবার প্রয়াস আছে বাধ্যতামূলক ত্রি-ভাষা নীতির মধ্যে। এক দেশ এক নীতিনামক রাজনৈতিক ধুয়াটি শুনিতে নেহাত নিরীহ হইতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহার মধ্যে দেশের বহু-সংস্কৃতির বিষয়টি লঙ্ঘিত হইবার বিপুল আশঙ্কা জ্বলজ্বল করিতেছে। বহুভাষিক, বহু-ধর্মী, বহু-সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে যে শাসক দল সম্মান করিতে জানে না, তাহার এই অতি-ত্বরান্বিত সংস্কার দেশের অনপনেয় ক্ষতি করিয়া দিতে পারে, সন্দেহ কী।

গাত্রদাহ

সকল মানুষই মরণশীল; কমলাকান্ত মানুষ, অতএব কমলাকান্ত মরণশীল। অবরোহী যুক্তিবিদ্যার এই উদাহরণটি একুশ শতকে হাস্যকর ও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে উল্টাইয়া ব্যবহার হইতেছে। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁহার বান্ধবী রিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠিয়াছে। তাহার তদন্তও হইতেছে। কিন্তু ইহার সমান্তরালেই ঘটিয়া গেল আশ্চর্য ঘটনাঅভিযুক্ত ঘটনাচক্রে বাঙালি বলিয়া সকল বাঙালি নারীর বিরুদ্ধে কদর্য অঙ্গুলি উঠিল। তর্জনের সারাৎসার, মন্দ মেয়ে রিয়া সুশান্তের উপর তুকতাক করিয়াছেন; রিয়া বাঙালি, সুতরাং সকল বাঙালিনিই মন্দ ও পুরুষদের তন্ত্রেমন্ত্রে বশ করিয়া থাকেন। কেহ বলিলেন, বাঙালি মেয়ে মাত্রেই ডাকিনী বা সর্পিণী, ফাঁদে ফেলিয়া কার্যোদ্ধারই তাঁহাদের মতলব।

অভিযুক্তের সূত্রে তাঁহার গোটা জাতি-গোষ্ঠীকে কাঠগড়ায় টানিয়া আনা কেবল কাণ্ডজ্ঞানহীনতাই নহে, চরম মূর্খতারও অভিজ্ঞান। কিন্তু তলাইয়া দেখিলে বুঝা যাইবে, এই অন্যায় বিচারসভা আহ্বানের মূলে রহিয়াছে বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের একাংশের নারীবিদ্বেষ তথা বাঙালি-বিদ্বেষ। যে নাগরিকেরা সকল বাঙালি নারী বর্জনের, এমনকি গণ-গ্রেফতারেরও দাবি তুলিলেনবিশ্বাস করিতে কষ্ট হইলেও সত্যতাঁহারা আসলে নারীকে এখনও সম্পত্তি বা পণ্য হিসাবে দেখেন, এবং জাতি হিসাবে বাঙালি নারী-স্বাধীনতায় তাঁহাদের তুলনায় অধিক বিশ্বাস করে বলিয়া, বাঙালি নারী জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভাস্বর হইতেছে েদখিয়া গাত্রদাহ ও মর্মপীড়ায় ভুগেন। প্রশাসন হইতে বিজ্ঞান, বিনোদন হইতে ব্যবসা, সাহিত্যক্ষেত্র হইতে শিল্পের অঙ্গনে বাঙালি নারীর অবাধ বিচরণ ও কীর্তিস্থাপন তাঁহাদের চোখে পড়ে না। তবে কিনা, দেখিয়াও না দেখিবার, সজ্ঞানে সরাইয়া রাখিবার এই আচরণ রাজনীতি-প্রভাবিতও বটে। আজিকার ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নারীকে প্রকাশ্যে দেবী ও অন্তরে দাসী হিসাবে দেখিতে চাহে, মানবী নহে। দেবী পূজা পাইলে তৃপ্ত, দাসীর তৃপ্তির কথা ভাবিবার দায় মালিকের নাইকিন্তু মানবীকে লইয়া মুশকিল, তাহার নিজস্ব মতামত আছে। সেই কারণেই শিক্ষা ও সমসময়ের মূল্যবোধ সহায়ে বাঙালি বা অন্য যে কোনও নারীরই অগ্রযাত্রা তাহার সহে না। অপ্রতিরোধ্য কাহাকেও রুখিতে গেলে ব্যক্তিগত ও জাতিগত কলঙ্কলেপনের জুড়ি নাই। সেই জন্যই নারীকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে নাবলিয়া বাঙালি পুরুষকে বিদ্রুপ, বা টিভি ও চলচ্চিত্রে বাঙালি নারীর রহস্যময়ী বা পরাবাস্তবানুগ চরিত্রায়ণ দেখিয়া অশিক্ষিত নিদানসকল বাঙালি নারীই ডাকিনী।

বাঙালি নারী এই জাতি ও লিঙ্গ-পরিচয়ভিত্তিক বিদ্বেষের প্রতিবাদ করিয়াছেন। আগাইয়া আসিয়াছেন পুরুষরা, অবাঙালি অন্য নাগরিকও। ভোজনরত স্ত্রীর পাশে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছেন স্বামী, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের বিখ্যাত দৃশ্য সমাজমাধ্যমে তুলিয়া কেহ লিখিয়াছেন, স্ত্রীটি কেমন জাদুটোনা করিয়াছে! ইহা নিশ্চিত ভাবেই শ্লেষোক্তি, কিন্তু অন্তরালে রহিয়াছে বহিরঙ্গে আধুনিক সমাজের প্রতি উদ্দিষ্ট এক অভিমান। তবে অভিমানিনী হইয়া বসিয়া থাকিলে বাঙালি নারীর চলিবে না। প্রতিবাদ নিশ্চয়ই কাম্য, কিন্তু সবার উপরে প্রয়োজন শুভ কর্মপথে আগাইয়া যাওয়া। এত দিন যাহা করিয়া আসিতেছিলেন, পূর্ণ বিশ্বাস ও সক্রিয়তায় তাহার সাধন। তাহাই যথেষ্ট।


No comments:

Post a Comment

বর্ণপরিচয়