বিদ্যাসাগর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী বক্তৃতামালা — ১
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
পৃথিবীতে বিখ্যাত মানুষ অনেক আছেন, কিন্তু
মহান মানুষ তাঁরা সকলেই নন। সৃষ্টিক্ষেত্রের, চিন্তন জগতের এবং কর্ম জগতের যে কোনও
দিকে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলে তিনি বিখ্যাত হতে পারেন। কিন্তু তাঁকে মহান বলা হয়
না। কোনও না কোনও ভাবে যিনি মানুষের সেবা করেছেন, তাঁর ক্ষেত্রেই মহান শব্দটি
প্রযোজ্য।
বিদ্যাসাগর একাধিক কাজের জন্য
বিখ্যাত, যেমন বাংলা গদ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং বাংলার শিক্ষাবিদদের
অন্যতম। কিন্তু যে কারণে তিনি মহান তা হল তাঁর মানবসেবার ব্রত। দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর,
দয়া তারই প্রয়োজন, যে আর্ত, বিপন্ন, অসহায়।
তাঁর সমস্ত কাজেই এই লোকসেবা
অর্থাৎ যার যেটা পাওয়া উচিত কিন্তু সেটা সে পাচ্ছে না; তার কাছে সেটা পৌঁছে দেওয়ার
দায়বোধ ছিল। তাঁর সব কাজেই এই সেবা পরায়ণতা অনুভব করা যায়।
সমাজ শ্রেণি বিভক্ত। এক শ্রেণি
অপর শ্রেণির দ্বারা অত্যাচারিত হয়। সমাজ গঠনের এই কাঠামো পরিবর্তন করা দরকার। এসব
তত্ত্ব কথা উনিশ শতকে বিশ্বের কোথাও কি শিক্ষিত উচ্চবর্গের মানুষেরা ভেবেছিলেন?
উনিশ শতকের ইউরোপ-এ এসম্পর্কে কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেন। তেমনই একটি
প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস নামে দুজন মানুষ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে রচনা করলেন
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। তখন বিদ্যাসাগরের বয়স আটাশ। তিনি কোনও দিনই সেই বই
পড়েছিলেন কিনা সন্দেহ। তাঁর মানবসেবা ব্রতে সমাজতন্ত্রবাদের তত্ত্ব কোনও দিনই বড়ো
হয়ে ওঠেনি। গাছ যেমন আলোর দিকে স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে যায়, দুর্গত মানুষ দেখলেই
তাঁর সাহায্য করার ইচ্ছা ছিল তেমনই স্বাভাবিক। সেই ইচ্ছাকে তিনি যথাসম্ভব ও
সাধ্যমতো কাজে পরিণত করার চেষ্টা করতেন। তাই যদি একটি বিশেষণে তাঁকে তুলে ধতে হয়,
তাহলে ‘মানবসেবাব্রতী’-এই শব্দটি ব্যবহার করতে চাই।
এই সেবা ব্রতের প্রধান অভিমুখ ছিল
তিনটি—ব্যক্তি-সেবা, গোষ্ঠী-সেবা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়াস যার মূলেও
ছিল সেবাব্রত। এই তিনটি দিকের পরিচয় আমি সামান্য দিতে চেষ্টা করছি—ব্যক্তি-সেবা ও
প্রাতিষ্ঠানিক সেবার দিকটি কম বলব। গোষ্ঠী-সেবার কথাটিই বলব বিশেষভাবে।
সব কথাই তাঁর মোটামুটি স্বীকৃত
জীবনীগ্রন্থ থেকে গৃহীত।
ব্যক্তিসেবা –
·
বীরসিংহ গ্রামের এক বিধবা বালিকার নিরম্বু উপবাসের কষ্ট দেখে তাঁর হৃদয়ে বেদনা জেগেছিল।
সেখান থেকেই বিধবা-বিবাহ আইন সিদ্ধ করার জন্য তাঁর ঝাঁপিয়ে পড়া।
·
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর গ্রামের বাড়িতে ডাকাতি হয়। তিনি গ্রামে এলেই গরিব মানুষদের দান করতেন। ডাকাতেরা ভেবেছিল তাঁর
টাকা আছে অনেক।
·
এই ব্যক্তিসেবার আর একটি দৃষ্টান্ত মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সাহায্য করা।
·
এই বিধবা বিবাহের আইন হবার পর ব্যক্তিগতভাবে কত বিধবা বালিকাকে যৌতুক দিয়ে
তিনি বিবাহ দিয়েছিলেন; অনেক সময় বাড়িতে রেখেছিলেন কোনও কোনও মেয়েকে তা-ও জানা যায়
তাঁর জীবনী থেকে।
প্রতিষ্ঠানসেবা-
·
প্রতিষ্ঠানসেবার কথায় আসি। শিক্ষার প্রসারের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন।
বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপনে আপ্রাণ
প্রয়াস। এ সবই সমাজের বালিকাদের জীবনকে একটু সুস্থ করবার চেষ্টা।
·
সংস্কৃত কলেজে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণ ছাড়াও উচ্চবর্ণের ছাত্রদের
প্রবেশাধিকারের চেষ্টা, তা-ও তো মানুষের-ই সেবার জন্য। শিক্ষার ব্যপারে সবসময় তিনি
সরকারি প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষীও ছিলেন না। ১৮৫২ –তে নিজের গ্রামে স্থাপন করেছিলেন অবৈতনিক
বিদ্যালয় -- নিজের খরচে।
·
বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত আইন করবার জন্য তিনি যে সংগ্রাম করেছিলেন, তাকে গুরুত্ব
দিতে নারাজ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথও এই বিষয়ে বিশেষ বাক্য ব্যায় করেননি।
আইন করে সামাজিক পরিবর্তন করা যায় না –এমনই ছিল অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তির অভিমত।
কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের জন্য আইনের ছত্র-ছায়ার যে প্রয়োজন আছে সেটুকু বোঝবার মতো বাস্তববোধ সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে
বিদ্যাসাগর অর্জন করেছিলেন। যার প্রয়োজনীয়তা এই একুশ শতকেও এদেশে আমরা বুঝতে পারি।
মানবসেবা-
·
সবশেষে আসব বিদ্যাসাগরের মানবসেবার গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। ব্যক্তিসেবা
আর গোষ্ঠীসেবার মধ্যে নীতিগত পার্থক্য কিছু নেই। ব্যক্তির সমাহারেই গোষ্ঠী।
বাঙালির সেবায় বিদ্যাসাগর আজীবন ব্যয় করেছেন। তাঁর শিক্ষাবিস্তারের প্রয়াস বাঙালির
উপকারের জন্য; বাঙালি নারীর নির্মম অবস্থান কিছুটা বদলাবার জন্য নিজের প্রাণ
বিপন্ন করেছেন বারবার। তাঁর সাহিত্য-প্রয়াস বাঙালির নিজস্ব সাহিত্যের অভাব
পূর্ণ করবার জন্য।
·
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বর্ধমান জেলায় ম্যালেরিয়া দেখা দিয়েছিল তখন
দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন এবং বাড়িভাড়া নিয়ে সেবার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি জীবনের
শেষ আঠারো বছর তাঁর কেটেছিল কার্মাটাঁড়ে, প্রধানত গরিব সাঁওতাল জনজাতির সংস্পর্শে এবং সেবায়। তাঁর
জীবনের এই পর্বটি নিয়ে দীর্ঘকাল কোনও গবেষণা হয়নি। কিন্তু এখন শুরু হয়েছে।
·
কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর যেভাবে জীবন কাটিয়েছিলেন সে-বিষয়ে বিহার-বাঙালি সমিতি
এবং বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি বহু প্রয়াসে বিদ্যাসাগরের জীবনের এই পর্বটির তথ্য
সংগ্রহ করেছেন; সেখানে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ করবার জন্য বহু কাজ করেছেন এবং করে
চলেছেন। এখান থেকেই বিদ্যাসাগরের জীবনের শেষ
পর্বে তাঁর মানব সেবাব্রতের চলচ্চিত্র আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
·
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে বীরসিংহ গ্রাম ত্যাগ করে কলকাতায় আসেন। বিভিন্ন কারণে নিজের
পরিবারের সঙ্গে এবং বীরসিংহ গ্রামের অনেকের সঙ্গেই তাঁর মত-বিরোধ দেখা দেয়। সেই মত
বিরোধ মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তিনি ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল তারিখে
কার্মাটাঁড়ে একটি বাগান সমেত বাড়ি কিনে বসবাস করতে শুরু করেন। বাড়িটি ছিল এক ইংরেজ
মহিলার। কেনার পর বিদ্যাসাগর বাড়িটির নাম দেন ‘নন্দনকানন’। অবশ্য কলকাতার জীবন
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি। বিভিন্ন কাজে কলকাতায়
আসতেন এবং আবার ফিরে যেতেন কার্মাটাঁড়ে।
·
কার্মাটাঁড়ে এসে বিদ্যাসাগর কী করলেন ? জায়গাটিতে ছিল জঙ্গল আর রুক্ষ
প্রান্তর। ভদ্র মধ্যবিত্ত মানুষজনের বসবাস ছিল না। কিন্তু বিদ্যাসাগর সেই ভদ্র
মধ্যবিত্তের সংস্পর্শ ত্যাগ করবেন বলেই তো কার্মাটাঁড়ে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর
জীবনী রচয়িতাদের একজন বিহারীলাল সরকার
বিদ্যাসাগরের উক্তি বল্র যা উল্লেখ করেছেন তা উদ্ধৃত হল –
“পূর্বে বড়
মানুষের সহিত আলাপ হইলে বড় আনন্দ হইত। কিন্তু এখন তাহাদের সহিত আলাপ করিতে
প্রবৃত্তি হয় না। সাঁওতালদের সহিত আলাপে আমার প্রীতি। তাহারা গালি দিলেও আমার
তৃপ্তি। তাহারা অসভ্য বটে, কিন্তু সরল ও সত্যবাদী।” (বিদ্যাসাগর জীবনী, ১৮৯৭)
·
কার্মাটাঁড়ে ছিল দরিদ্র, নিরক্ষর, সাঁওতালদের বাস। সেই দারিদ্র আমরা কল্পনাও করতে পারব না। তারা ভালো খাবারের স্বাদই জানত না।
তারা অসুখ করলে মরে যেতেই জানত। কিন্তু ঔষধ খেতে চাইত না। কারণ ঔষধ কী তাই-ই তাদের
জানা ছিল না। সহজে জলও পাওয়া যেত না সেখনে। সেবাব্রতী বিদ্যাসাগর কেবল নিজের কাজ
নিয়ে কি থাকতে পারেন ? কলকাতা থেকে কাগজপত্র নিয়ে চলে যেতেন, বাড়িতে বসে প্রুফ
দেখতেন, কিন্তু সেইসঙ্গে সাঁওতালদের খাদ্য-সংস্থানের চিন্তা করতেন। সাঁওতালেরা
কেবল ভুট্টাচাষ করতেই জানত। সেই ভুট্টা মহাজন কিনে নিয়ে যেত অতি সামান্য দামে।
মহাজনের বদলে বিদ্যাসাগর কিনে নিতে শুরু করলেন এই
ভুট্টা। বাড়িতে জমে যেত ভুট্টার
পাহাড়। আবার প্রতিদিন দুপুর থেকে উপবাসী সাঁওতালেরা জড়ো হত। বিদ্যাসাগর তাদের
দিতেন ভুট্টা আর নুন। পেট ভরে খেয়ে ‘খুব খাইয়েছিস’ বলে তারা চলে যেত।
·
বিদ্যাসাগর তাদের অসুখে হোমিওপ্যাথি
ঔষধ দেওয়া শুরু করলেন। কোনোদিন তারা ঔষধ খায়নি। অল্প খেলেই কাজ হত। তারপর তিনি
স্থাপন করলেন দাতব্য চিকিৎসালয় এবং সবশেষে অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় –কঠিনতম কাজ।
সেবাব্রতী বিদ্যাসাগর কার্মাটাঁড়ে সাঁওতালদের কাছে একাই ছিলেন মহাজন, চিকিৎসক এবং
শিক্ষক। সর্বোপরি তাদের অন্নদাতা। এখানে ‘অন্ন’ অর্থে ভুট্টা বুঝতে হবে।
·
শোনা যায় কার্মাটাঁড়ের নিচু প্ল্যাটফর্ম-এ বিদ্যাসাগর একবার ট্রেন থেকে নামতে
গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। সাঁওতালরা তীর-ধনুক,
টাঙ্গি নিয়ে এসে প্ল্যাটফর্ম উঁচু করে দেবার দাবিতে রেললাইন অবরোধ করেছিল। বিদ্যাসাগরের
অনুরোধেও তারা নড়েনি। হয়তো বিদ্যাসাগর ছিলেন বলেই ব্রিটিশ সরকার গুলি চালিয়ে তাদের
সরিয়ে দেবার বদলে সত্যিই উঁচু করে দিয়েছিল প্ল্যাটফর্ম।
·
বিদ্যাসাগরের এই কার্মাটাঁড়-বাসের বিবরণ দু-একজন মাত্র লিখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাঁর ‘কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে তিনি যে বিবরণ
দিয়ে গেছেন তার কিছু অংশ উদ্ধৃত হল –
প্রবন্ধটি
পাওয়া যাবে – হরপ্রসাদ রচনাবলি-র দ্বিতীয় সম্ভারে (সম্পাদনা – সুনীতিকুমার
চট্টোপাধ্যায় ইস্টার্ন ট্রেডিং কোং, ১৯৬০, পৃষ্ঠা – ৩ - ২০)
“রৌদ্র
উঠিতে না উঠিতেই একটা সাঁওতাল গোটা পাঁচ-ছয় ভুট্টা লইয়া উপস্থিত হইল। বলিল – ও
বিদ্যাসাগর, আমার পাঁচ-গণ্ডা পয়সা নইলে আজ আমার ছেলেটার চিকিৎসা হইবে না; তুই আমার
এই ভুট্টাকটা নিয়া আমায় পাঁচগণ্ডা পয়সা দে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তৎক্ষণাৎ পাঁচ আনা
দিয়া সেই ভুট্টাকটা লইলেন ও নিজের হাতে তাকে তুলিয়া রাখিলেন। তারপর আর একজন
সাঁওতাল, তার বজরায় অনেক ভুট্টা; সে বলিল ---আমায় আট গণ্ডা পয়সার দরকার।
বিদ্যাসাগর মহাশয় আটগণ্ডা পয়সা দিয়াই তাহার বাজরাটি কিনিয়া লইলেন। আমি বলিলাম –
বাঃ, এ ত বড় আশ্চর্য। খরিদ্দার দর করে না, দর করে যে বেচে। বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু
হাসিলেন, তারপর দেখি – যে যত ভুট্টা আনিতেছে, আর যে যত দাম চাহিতেছে, বিদ্যাসাগর
মহাশয় সেই দামে ভুট্টাগুলি কিনিতেছেন আর তাকে রাখিতেছেন। আটটার মধ্যে চারিদিকের
তাক ভরিয়া গেল, অথচ ভুট্টা কেনার কামাই নাই। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম – এ ভুট্টা লইয়া
আপনি কি করবেন –দেখবি্ রে দেখ্বি।”
* * * *
*
“ভুট্টা কেনা চলিতে লাগিল। একটু অন্য
কাজে গিয়াছি, আসিয়া দেখি –বিদ্যাসাগর নেই। সব ঘর খুঁজিলাম --- নেই, রান্নাঘরে নেই,
বাগান সব খুঁজিলাম নেই, শেষে বাগানের পিছন দিকে একটা আগড় আছে –সেটা খোলা; মনে
করিলাম, এইখান দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছেন; সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম। কিছুক্ষণ পরে
দেখি, একটা আল্পথে বিদ্যাসাগর মহাশয় হন্হন্ করিয়া আসিতেছেন, দর্ দর্ কর্যা
ঘাম পড়িতেছে, হাতে একটা পাথরের বাটি। আমাকে সেখানে দেখিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া
জিজ্ঞাসা করিলেন –তুই এখানে কেন ? আমি বলিলাম –আপনাকে খুঁজিতেছি, কথায় গিয়াছিলেন ?
তিনি বলিলেন ---ওরে খানিকক্ষণ আগে এক সাঁওতালনী আসিয়াছিল; সে বলিল ---বিদ্যাসাগর,
আমার ছেলেটার নাক ফিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস। তাই আমি
একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এই বাটি করে নিয়ে গেছিলাম। আশ্চর্য্য দেখিলাম ---একডোজ ঔষধে
তার রক্ত পড়া বন্ধ হইয়া গেল। ইহারা ত মেলা ঔষধ খায় না, এদের অল্প ঔষধেই উপকার হয়,
কলিকাতার লোকের ঔষধ খেয়ে খ্যে পেটে কড়া পড়িয়া গিয়াছে, মেলা ঔষধ না দিলে তাদের
উপকার হয় না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম ---কতদুর গিয়েছিলেন ? তিনি বলিলেন ---ওই যে গাঁ-টা দেখা যাচ্ছে, মাইল-দেড়েক হবে। আমি পূর্ব্ব হইতেই জানিতাম
বিদ্যাসাগর মহাশয় খুব হাঁটিতে পারিতেন। বাংলায় আসিয়া চাহিয়া দেখি, বাংলার সম্মুখের
উঠান সাঁওতালে ভরিয়া গিয়াছে –পুরুষ মেয়ে
ছেলে বুড়ো –সব রকমের সাঁওতালই আছে। তারা দল বাঁধিয়া বসিয়া আছে, কোনো দলে পাঁচ জন,
কোনো দলে আট জন, কোনো দলে দশ জন। প্রত্যেক দলের মাঝখানে কতকগুলা শুক্না পাতা ও
কাঠ। বিদ্যাসাগরকে দেখিয়াই তাহারা
বলিয়া উঠিল –ও বিদ্যাসাগর, আমাদের খাবার দে। বিদ্যাসাগর ভুট্টা পরিবেশন করিতে বসিলেন।
তাহারা সেই শুকনা কাঠ ও পাতায় আগুন দেয়,
তাহাতে ভুট্টা সেঁকে, আর খায় : -- ভারী ফুর্ত্তি। আবার চাহিয়া লয় –কেহ দুটা, কেহ চারটা ভুট্টা খাইয়া ফেলিল। তাকের রাশিকৃত ভুট্টা প্রায় ফুরাইয়া আসিল। তাহারা উঠিয়া বলিল – খুব খাইয়েছিস বিদ্যেসাগর। ক্রমে চলিয়া যাইতে লাগিল। বিদ্যাসাগর রকে দাঁড়াইয়া
দেখিতে লাগিলেন, আমিও আশ্চর্য্য হইয়া ভাবিতে লাগিলাম; ভাবিলাম এ রকম বোধ হয়
আর দেখিতে পাইব না।”
No comments:
Post a Comment