সতীনাথ ভাদুড়ী: জন্মদিনে কিছু কথা
বিহারে একই শহরে থাকা আমাদের। একই পাড়ায়। বহু বছর আগে তখন অপরিণত মন তাই বুঝতে পারিনি মানুষটির মহীরূহ উচ্চতা। তাঁর মননশীলতা ও বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ত্বের অতলান্তি গভীরতা মাপার ক্ষমতা হয়নি তখন। এখন কি হয়েছে তা ?
শুধু সময়ের নিয়ম মেনে শরীরের বয়েস
হওয়া। তবু যেহেতু একই জায়গার মানুষ তাই এই সাহস বা লেখার ইচ্ছেটুকু।
ফনীশ্বর নাথ রেণু লিখেছেন মারে গএ
গুলফাম। আমরা জানি তিসরী কসম সিনেমা সেই কাহিনীর চিত্ররূপ।
উনি ছোটবেলায় আসতেন বাবার সঙ্গে
সতীনাথের বাড়িতে। লক্ষ্য করছিলেন সতীনাথের বাবার সততা, মূল্যবোধ। পরবর্তী
সময়ে রেণু যখন সেন্ট্রাল জেল, ভাগলপুরে ভাদুড়ীজীর সঙ্গে
রাজনৈতিক বন্দী। তিনি দেখলেন সতীনাথের চরিত্রও বাবার মত সততা মূল্যবোধ জাড়িত। রেণুজীর
ভাদুড়ীজী। সম্পর্কটি শ্রদ্ধার ও ভালবাসার। কত বিষয়ে জানার আগ্রহ সতীনাথের। পূর্ণিয়ার
এই মানুষটির বিহারের এই শহরটির প্রতি এক আশ্চর্য্য টান। আজন্ম তাই এখানেই থাকা। পূর্ণিয়াতে
থেকেই সাহিত্য সৃজন। গতানুগতিক পথধরে লেখা নয়। এক নতুন আঙ্গিকে নিজেকেই অতিক্রম
করে যাওয়া। তাই শ্রদ্ধেয় মুজতবা আলী বলেছেন Writers writer. লেখকের
লেখক হয়ে ওঠা পূর্ণিয়া শহরের মিতভাষী সৌম্য দর্শন মানুষটির। পূর্ণিয়ার মাটির আন্চলিক
রূপকার কি যত্নের সঙ্গে রচনায় নিয়ে এলেন স্থানীয় চরিত্র ঢোঁড়াই, বদরা মুচিদের। তাঁর অতি নিবিষ্ট পর্য্যবেক্ষণে পূর্ণিয়া ও তার আশেপাশের
অন্চল খুঁজে পেল লেখকের হাত ধরে সাহিত্যের অনির্বচনীয় পৃষ্ঠভূমি। মরেঙ্গা হয়ে গেল
মরগামা। তাঁর বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের তাতমাটোলার ঠাকুরবাড়ি হয়ে গেল মিলিট্টি
ঠাকুরবাড়ি। আমাদের পাশের শহর কাটিহার তাঁর লেখায় মাটিহার আর তাঁর নিজের প্রিয়
বিচরণ ভূমি পূর্ণিয়া হয়ে গেল জিরানিয়া।
সুধী একটা প্রশ্ন তৈরী হয়। সাহিত্যের
নতুন ইতিহাসের নির্মাণ কি এরকম ভাবেই হয়? পর্য্যবেক্ষণের নিবিষ্টতায়, মননশীলতার গভীরতায় মিশে যায় লেখকের অন্দরমহল অনুভূতি। হাতের তালুর মতন সতীনাথের
চেনা আমাদের শহর ও বিহারের গ্রাম্যজীবন। পরিশ্রমী অভিজ্ঞতা।একটার পর একটা গ্রামের
ভেতরে যাওয়া। সেখানকার মাটি কাদা খড়ের চালের নীচে বসত করা গ্রাম্যজীবন ও মানুষজনের
সঙ্গে আন্তরিক ভাবে মেলামেশা। এ সমস্ত উপাদানের সঙ্গে যোগ হয়েছে সতীনাথের মেধা, অন্য জাতের চেতনা। তাঁর বিস্তৃত বহুস্তরীয় অধ্যয়ন, প্রকৃতি
রহস্যের অপার জিজ্ঞাসা, বৈজ্ঞানিক কৌতূহল।
কোন লেখাটির কথা বলব? কোনটির উল্লেখ
করব না ? বড় জটিল এই বেছে নেওয়া। একটি উপন্যাসের বিষয় ১৯৪২
এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিকায় আলো ফেলে। প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার সম্মানে
আলোড়ন ফেলে পাঠক সমাজে, বুদ্ধিজীবী সমালোচক মহলে।
সকলেই জানেন জাগরীর কথা বলছি। নতুন
মাইল স্টোন গাঁথা হয়ে যায়। আবার যদি বলি ঢোঁড়াই চরিত মানস। তাঁর এই উপন্যাসের মেজাজ অন্যরকম। এখানে মধ্যবিত্ত
জীবনের ছবি আঁকা হয় নি।আঙ্গিকের অভিনবত্ব, তাতমাটুলির কাহিনী, ঢোঁড়াই, বুধনী, বৌকা বাওয়ার
আখ্যান কখন যেন কালোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে।
আমার ক্ষমতার বাইরে ব্যতিক্রমী
সাহিত্যিক সতীনাথের অসাধারণ সাহিত্য ও বহুমুখী জীবনধারা কাজের সঠিক পুঙ্খানুপুঙ্খ
বিশ্লেষণ। তাঁর রচনা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে প্রথম শ্রেণীর পত্র পত্রিকায়। দেশ, অমৃত, পরিচয়, আনন্দবাজার পত্রিকা ও অন্যান্য সাহিত্য
পত্রে।
পূর্ণিয়ার সুবল গাঙ্গুলি সম্পাদিত
সতীনাথ স্মরণে, আলো রায়ের এই পরবাস, আফিফ ফুয়াদের সম্পাদনায় দিবারাত্রির
কাব্য উল্লেখযোগ্য কাজ সতীনাথ সার্বিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে।
বিনম্রতার সঙ্গে বলি আমার ঠাকুমার
নাম রত্নময়ী দেবী। সতীনাথ আসতেন আমাদের বাড়িতে। দিদির কাছে ভাইফোঁটা নিতে। ঠাকুমার
খুড়তুত ভাই সতীনাথ ভাদুড়ী। আমাদের বাড়ির বারান্দায় নিয়মিত বিকেলবেলায় আসতেন সতীনাথ
সহপাঠী ও ফুটবলার সুধীর চ্যাটার্জি (নীলু দাদু)। গল্প আড্ডা হত কৃপানাথ ভাদুড়ীর
সঙ্গে। কৃপানাথ সতীনাথের সতীর্থ ও খুড়তুত ভাই। তিনি আমার দাদু। আজকের বিশেষ
দিনটিতে আবেগ তাড়িত তাই হয়ত ব্যাক্তিগত স্মৃতিচারণা।
আমাদের পূর্ণিয়া শহরের একটি
নান্দনিক শিল্প সংস্কৃতি, খেলাধূলো ফুটবল এ্যাথেলেটিক্স পরম্পরার গৌরবোজ্জল ইতিহাস
রয়েছে। পুরোধা ব্যাক্তিত্বরা রয়েছেন। সেই নক্ষত্রমণ্ডলে সতীনাথের অবস্থান আমাদের
প্রাণিত করে। যেন আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শহরের স্বর্ণিম ঐতিহ্যকে নিয়ে যেতে
পারি অন্য উচ্চতায়। ২৭ শে সেপ্টেম্বর ২০২০। তাঁর জন্মদিনে আজ এই অঙ্গীকার হোক তাঁর
প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।
অপরাজেয় কথাশিল্পীকে জানাই
বিনম্র প্রণাম।
অজয় সান্যাল
বিহার বাঙালি সমিতি, পূর্ণিয়া শাখা।
No comments:
Post a Comment