-নব বর্ষের এ কাল ও সেকাল - তৃষা পাল


ইংরেজি ক্যালেন্ডার সরিয়ে পঞ্জিকা এলো ঘরে
আকবর হিজরী সন সরিয়ে বঙ্গাব্দ গড়ে |
চন্দ্র গণনা বাদ দিয়ে সৌর আরবি মিশে
ফসল তোলা আয়কর মেলে অনায়াসে |
জাত ধর্ম ভুলে গিয়ে মিলিত হয় বাঙালি
মুর্শীদ কুলি খাঁ, মিষ্টান্ন মুখের প্রবর্তক জানি |
আজ বাঙালির ব্যবধান ,তবু কি থাকবে দূরত্ব?
বাঙালির মিলন মেলায় শিল্প মহলে গুরুত্ব
রবি নজরুল এক হয়ে ভাঙে কাঁটাতার
দুই বাংলার উজ্জাপন বর্ষবরণ আধার |
গান কবিতা প্রযুক্তিতে এক সেতু তৈরী
নববর্ষের নব পরিধান , লাল খাতার শৈলী
অর্থনীতি নির্ভর হয়ে বঙ্গাব্দ বরণ
দোকান পাটে ঋণ সোধে নতুন বর্ষ স্মরণ
অদেখা শত্রু আজ রাখে গৃহবন্দী করে
তবু নববর্ষ হরষে আসে বাংলার আবেগ ভরে |--------
লিখতে বসেছি নব বর্ষের একাল ও সেকাল। কি লিখবো ভাবতে গিয়ে মেগাসিরিয়াল এর মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার ছোটবেলার নব বর্ষের আনন্দ ফুর্তি উল্লাসে কাটানো দিনগুলো ।
পরিবর্তনের দুটো যুগেরই সাক্ষী আমি ।
ছোটবেলায় নববর্ষ অন্যরকম ছিল । মায়ের সাথে আমরা বোনরাও কাকভোরে উঠে গঙ্গা স্নানে যেতাম ।।দুয়ারে আলপনা আঁকা হতো ।সদর দরজা আম পাতা আর সোলার বল দিয়ে সাজানো হতো ।রেডিও থেকে ভেসে আসা রবীন্দ্র সংগীত , এসো হে বৈশাখ এসো এসো । আমরা মায়ের হাতের সেলাই করা ছিটের নতুন জামা পরে বড়দের প্রণাম , মা ঠাকুরমায়ের আশীষ ,বড়দের দেখাদেখি আমরা ও করতাম কোলাকুলি ।ঠাকুরমার হাতের নাড়ু নতুন গুড়ের পায়েস দুপুরে ভাত কিংবা পোলাও মাংস সাথে দই মিষ্টি সব যেন কেমন নতুন বছরের গন্ধ বয়ে আনতো। তারপর বিকেলে ছিল হালখাতা। মুদি দোকান থেকে সোনার দোকান সব দোকানে দাদাদের সাথে গিয়ে মিষ্টির প্যাকেট ,ক্যালেন্ডার আর কপালের জোর থাকলে কাঁচের বোতলে কোকোকোলা । বাড়ি ফিরে সেগুলো ভাইবোন মিলে ভাগ করে খাওয়া সে যে কি আনন্দ ভুলতে পারি না ।সন্ধের পর পাড়ায় কারও বাড়ির উঠানে বা ছাদে গান নাচ ও কবিতার আসর সেখানে বড়দের সাথে ছোটরা ও অংশ নিত ,কোন কোন বাড়িতে কীর্তন হতো সেসব বাড়িতে প্রসাদ খেতে যাওয়া সে ও ভারী আনন্দ ।
সে আনন্দ যেন একটা নতুন বছরের আনন্দ বয়ে আনতো।
দিন যায় দিন আসে । সে কালের মত এ কালের সূর্য ও একই ভাবে উদয় হয়
কালের স্রোতে এখোনো নতুন বছর আসে ।যুগের সাথে পরিবর্তন এই তো সংসারের নিয়ম । সেকালে র নব বর্ষ আর এ কালের নব বর্ষের তফাৎ বুঝতে পারি । আজকাল আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের পাঠানো শুভ নববর্ষের ছবি গান আর মেসেজে ফোনের ইনবক্স ভরে যায় ,ফেসবুকের
বন্ধুরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায় ।
নব বর্ষের দিন বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম কোলাকুলি র হয়তো কিছুটা এখন ও প্রচলন আছে । মায়ের হাতে তৈরি ছিটের জামার পরিবর্তে ছেলে মেয়েরা শপিং মলে যায় নিজেদের জামা কাপড় পছন্দ করে কিনে আনে । রেস্টুরেন্টের মোমো পিৎজা বিরিয়ানী চাইনিজ বেশ আয়েশ করে খায় ।প্রিয়জনদের উপহার দিয়ে ও নব বর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয় ।
হালখাতা চল নেই কারন বাড়ির সবই প্রয়জনীয় জিনিস তো বিগ বাস্কেট বা শপিং মল থেকে আসে।
ঐ দিন পিকনিক বা আউটিং এর চল এখন বেশী।পাড়ার ক্লাবে বা বন্ধু বান্ধব রা মিলে গান বাজনা নিজেদের মত করে ।
বৈশাখী মেলার আনন্দ থেকে আমাদের ছেলে মেয়েরা বঞ্চিত ।দল বেঁধে আমরা বাড়ির ছোটরা যেতাম গ্রামের মাঠে বসা বৈশাখী মেলায়। একটি গোটা সিদ্ধ ডিম কিংবা পুরো একটি আলুর দম কাঠিতে ঢুকিয়ে খাওয়ায় যে আনন্দ, পুতুল নাচ ,নাগর দোলা আজ ও মনের কোঠায় জ্বল জ্বল করছে।
আজ আমার সন্তানরা নব বর্ষের দিন বড় বড় ফাস্টফুডের দোকানে গিয়ে বার্গার, সাসলিক কিংবা স্যান্ডউইচ খেয়েও কি সে আনন্দ পায়? আনন্দ পাওয়ার সে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কিংবা মানসিক প্রস্তুতি কি তাদের আছে? নেই। চরকিতে চড়া, বায়োস্কোপ দেখার খুশি খুশি মুখ কি আজ সিনেপ্লেক্সে পাওয়া যায়? হয়তো অনেকে বলবে, আমরা আধুনিক হয়েছি, প্রযুক্তি এগিয়েছে—পুরনোকে আঁকড়ে ধরে কী লাভ? আমি বলব, সে-ই প্রকৃত আধুনিক, যে নিজের অস্তিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে নতুনকে আবাহন করে।
বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজার পর নববর্ষের এই উৎসব অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন, ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি ভাবীকালের মঙ্গল ও শুভর কামনায় এর প্রতিটি উপাদান থাকে সজীব। শোষণ, শাসন, তোষণ কিংবা পশ্চাত্পদ ভাবাদর্শ কোনো কিছুই বাঙালির নিজস্ব শক্তির অফুরন্ত আধার থেকে আমাদের বিচ্যুত করতে পারেনি, হয় তো পারবেও না কোনো দিন।আমাদের পরের প্রজন্ম কি করবে বলা কঠিন ।----------


1

1 comment:

  1. নতুনের সঙ্গে নবীনের সঙ্গে চলার নামই প্রবাহ ।
    নববর্ষ নতুন পঞ্জিকা নতুন হালখাতা । নবীন কে যেমন আহ্বান করতে হবে বরণ করতে হবে এটাও ঠিক যে পুরাতন কেও আঁকড়াতে হবে। পায়স পিঠে চচ্চড়ি মালপুয়া - এ সবকেও জীইয়ে রাখতে হবে মোমো পাস্তা পিজ্জার সঙ্গে। সকলকে জানাই
    নবব‍র্ষের শুভেচ্ছা ও প্রীতি।

    ReplyDelete

বর্ণপরিচয়