'নজরুল স্মরণে' ~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ

 'নজরুল স্মরণে'

~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ


চতুর্থ পর্ব



নজরুলের‌ও আগে আমাদের সাহিত্যে বিদ্রোহের সুর ক্রমশঃ উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়ে উঠছিল। ‌১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর সোচ্চার আবির্ভাবের আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, স্বভাব কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস, ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, দেহবাদী কবি মোহিতলাল মজুমদার ও অতুল প্রসাদ সেনের কবিতায় আগে থেকেই বিদ্রোহের সুর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। অন্য দিকে আবার পরাধীন ভারত - সন্তানের মনে দেশপ্রেমের ভাব জাগরিত করার জন্য গিরীশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রমুখদের নাটকে ইংরেজ - বিরোধিতার সুর আর এই পরিপ্রেক্ষিতে 'বন্দে মাতরম'- এর সম্পাদক ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, 'যুগান্তরে'- র সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং 'সন্ধ্যা' পত্রিকার সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রমুখদের রচনায় দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বিদ্রোহভাব ক্রমশঃ জমাট বাঁধছিল। এখন সত্যের খাতিরে আমাদের স্বীকার করেই নিতে হবে যে তৎকালীন এই ব্যক্তিত্বেরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নজরুল -  সাহিত্যকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিলেন। এই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলেও প্রধানতঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আমাদের কবির বহু আগেই সাহিত্যে মেহনতী জনগণের কথা আর সেই সঙ্গে বলিষ্ঠ সাম্যবাদকে একটি শক্তিশালী ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। সমাজের নিপীড়িত ও অবহেলিত জনসাধারণের বেদনা - জর্জরিত নিত্যকার নানা জীবনের কথা এঁদের লেখনীর মাধ্যমে বলিষ্ঠ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এমনকি যে তীব্র যৌবন - আবেগ নজরুলের কবিতাকে একটি বিশেষ স্বীকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তার প্রথম প্রকাশ নিঃসন্দেহে সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যেই লক্ষ্য করা গেছে। এই কারণে গবেষকেরা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকেই নজরুলের একমাত্র সার্থক পূর্ব- সূরী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে এটা অনস্বীকার্য যে সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যে সমকালীন সমাজ ও কালচেতনা শুধুমাত্র যেখানে ইশারা বা ইঙ্গিতের মাধ্যমে আমাদের মাঝে একটা অশান্ত স্ফূলিঙ্গের মতো দেখা দিয়ে উড়ে গেছে, সেখানে কালসচেতনতা ও তৎকালীন সমাজে ব্যাপ্ত অনিয়ম আর উচ্ছৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নজরুলের কাব্যে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ও জীবন্ত। যথার্থতা হলো এই যে নির্যাতিত ও নিপীড়িতদের প্রতি বেদনায় কবি আকন্ঠ ডুবে থাকায় তাঁর বিদ্রোহ স্বাভাবিক কারণেই স্বীয় কাব্যে অধিকতর সোচ্চার হয়ে উঠেছে।


নজরুল প্রথম থেকেই বিদ্রোহী, "আমি শ্রাবণ - প্লাবন - বন্যা, কভু - ধরণী - রে, করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস - বন্যা -- আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু - বক্ষ হ‌ইতে যুগল কন্যা।" তিনি চির বিদ্রোহী বীর। সৃষ্টি - সুখের - উল্লাসে কবি এগিয়ে চলেছেন সাম্যের গান গাইতে - গাইতে। "গাহি সাম্যের গান -- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা - ব্যবধান, যেখানে মিশিছে হিন্দু - বৌদ্ধ - মুসলিম - ক্রীশ্চান। গাহি সাম্যের গান।" 


নজরুল নতুনকে পুরোনোর জায়গায় মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এগিয়ে চলেছেন আর সেই সময় দেশবাসীকে বীর্যের ক্ষেত্রে সত্যের সন্ধানে এগিয়ে এসে নতুন সৃষ্টির জন্য সরবে ডাক দিয়েছেন তিনি অকম্পিত চিত্তে। বস্তুতঃ পক্ষে নজরুলের ব্যক্তিত্ব ও কবিত্ব মিলে একাকার হয়ে যাওয়ায় কবিতায় ও গানে উদ্দাম - উচ্ছাস আর বিদ্রোহ ও উদ্দীপনাকে কাব্য রূপ দেওয়ার সঙ্গে - সঙ্গে তাঁর চিত্তে সনাতন পন্থীদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের অভিযোগ, যেগুলি এতদিন ধূমায়িত অবস্থায় ছিল, সেগুলি কাব্য রূপ লাভ করে। লক্ষণীয় যে এক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া - কালে আমাদের কবি কোন ধরণের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর জাতিভেদকে সামান্যতম প্রশ্রয় না দিয়ে  তৎকালীন  সমাজে প্রচলিত 'বাদের' উর্ধ্বে উঠে তিনি চার দিকের অনিয়ম আর সমস্ত বাঁধন আর নিয়ম - কানুন আর শৃঙ্খলকে দুর্বার বেগে ভেঙ্গে চুরমার করতে - করতে বিশ্ব - বিধাত্রীর বিদ্রোহী - সুত নজরুল এগিয়ে চলেছেন -- মনে - প্রাণে তখন তিনি একজন যথার্থ স্বদেশী - নির্ভেজাল একজন। সমাজের চতুর্দিকে ব্যাপ্ত  মনুষ্যত্বের অবহেলা ও মানবিকতার অবমাননায় বিব্রত কবি কালক্ষেপ না করে নিজের অগ্নিবর্ষী লেখনীর মাধ্যমে মানুষের জয়গানে চতুর্দিকে তুফান তুলেছিলেন। "সাম্যের গান গাই! -- যত পাপী - তাপী সব মোর বোন, সব‌ হয় মোর ভাই। এ পাপ মুলুকে পাপ করেনিক' কে আছে পুরুষ - নারী? আমরা তো ছার; -- পাপে পঙ্কিল পাপীদের কান্ডারী।.. হেথা সবে সমপাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়া অন্যের পাপ মাপি।"


শুধু গান আর কবিতাই নয়, নিজের আলোড়নকারী মানসিকতাকে আরো বেশি দুর্দম করার তাগিদে নজরুল 'ধুমকেতু' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল আচার - অনুষ্ঠানের বেড়াজাল ভেঙ্গে নতুন চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণের প্রাচুর্য লক্ষ্য করে তিনি সমাজ - স্থিত অন্যায় - 

অবিচারের স্বরূপ উদঘাটন কল্পে প্রকাশিত এই পত্রিকা, রাজশক্তির ভিত্তিতে আঘাত করে। শাসক বর্গ সচকিত হয় এবং আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করবো যে 'ধুমকেতু' সন্ত্রাসবাদে প্রেরণা জোগাচ্ছে, এই মিথ্যা অভিযোগে পত্রিকাটিকে বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং কবি কারারুদ্ধ হন। বলাই বাহুল্য, এর পরের এগারো মাসের কারাগারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, আমাদের কবিকে আরো বেশি ক্ষিপ্ত ও ক্ষিপ্র করে তুলেছিল।

No comments:

Post a Comment

বর্ণপরিচয়