আমাদের সেই কনকদা
শ্রী কনক অধিকারী (১৯৫২- ২০২০)
শ্রী প্রসেনজিৎ দত্ত, আমেদাবাদ
বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়, যে এই দুর্ধর্ষ আবেগপ্রবণ বঙ্গসন্তানটি কোন ধনীর দুলালের ঘরের নন। নেহাতই দুবেলা দু'মুঠো শাকান্ন জোটানো ঘরের ছেলে। শ্রী কনকদাস অধিকারী। চাল ফুটো হয়ে যে ঘরে, ঝড়ে পড়ে বর্ষার বারিধারা, সেই মাটির ঘরে, সেই দীনের ঘরে, জন্ম ১৯৫২ সালের ২৩শে অক্টোবর। বাবা জগন্নাথ অধিকারী। মা গৌরীদেবী। পাঁচ ভাই এক বোনকে নিয়ে ভরা সংসারে কনকদা বড় ছেলে। ছেলেবেলা থেকেই দায়িত্ব আর কর্তব্যে অবিচল। ত্যাগবরণের জন্য প্রতিনিয়ত প্রস্তুত থাকা কনকদার জীবনের একটা অন্যতম রুটিন। পশ্চিম মেদিনীপুরের লোকপীঠ গ্রামের স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা। সালটা বোধকরি ১৯৬৫-৬৬। মামার বাড়ির কিছু অংশ পেয়ে বিরাট এক মাটির বাড়ি তৈরি করে রাধামোহনপুরে উঠে এল অধিকারী পরিবার। কনকদা রাধামোহনপুরের বিবেকানন্দ হাইস্কুলে ভর্তি হলেন। সংসারের অভাব মেটাতে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে গৃ্হশিক্ষকতা, এমনকি মাটি কাটার কাজও করতে হত। উচ্চ-মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হবার পর মেদিনীপুর টাউনে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন। প্রতিদিন ১৫ কিমি সাইকেল চালিয়ে যেতে হত। অদম্য জেদ আর লড়াই।
১৯৭৬ সাল। ওয়েস্ট বেঙ্গল
বস্ত্রবিপনী 'বঙ্গশ্রী'র কাজে কনকদা মাত্র ৭ দিনের জন্য আমেদাবাদ
আসেন। ১৯৭৭ সাল থেকে পাকাপাকিভাবে আমেদাবাদে 'বঙ্গশ্রী'র নতুন শোরুমের ম্যানেজারপদে। নিজ কর্মদক্ষতায় 'বঙ্গশ্রী'র মতো একটি বঙ্গপ্রতিষ্ঠানকে আমেদাবাদ শহরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশ ও প্রাথমিক শিক্ষকতার চাকরী প্রত্যাখ্যান
করেন। 'বঙ্গশ্রী'তে চাকরীর সাথে সাথে
মর্নিং কলেজ করে গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন।
সেই সময় 'বঙ্গশ্রী' ছিল বাঙালিদের আড্ডার স্থল। সেখান থেকেই বেঙ্গল কালচারাল এসোসিয়েশনের সঙ্গে
সখ্যতা এবং জড়িয়ে যাওয়া। এরপর কনকদা কর্মকুশলতার
জন্য গুজরাত 'হস্তকলা-হাট'এর
উচ্চপদে আসীন হলেন। আবার নতুন চ্যালেঞ্জ। গুজরাত সরকারের চাকরী। কনকদার পরামর্শে
এবার কোলকাতায় খোলা হল গুজরাত 'হস্তকলা-হাট'এর নতুন শাখা। আসলে মানুষটা চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসতেন।
নিজের রান্না নিজেই করা, আর বন্ধুদের সাথে হৈ-হল্লা করে জীবন বেশ কাটছিল। কিন্তু অবসন্ন প্রহরে, নারীর হৃদয় পাওয়ার নেশা ধরাতো পলাশকুঞ্জে। ঠিক এমন সময়ে কনকদা'র জীবনে প্রবেশ সম্ভ্রান্ত গুজরাতি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে ভারতী ব্যাস। প্রণয় থেকে পরিণয়। শুভবিবাহ ১৯৮১ সাল, ১১ই মে। বৌভাত লালদরওয়াজার এসোসিয়েশন কক্ষে। বিয়ের পর কনকদা ভারতীবৌদিকে একটি শর্ত দিলেন যে, " আমার মা গ্রামের বাইরে খুব একটা কোথাও যান নি। তোমাকে বাংলা শিখতে হবে।" ভারতীবৌদি বাধ্য ছাত্রীর মত খুব অল্পদিনেই বাংলা বলা রপ্ত করে নিলেন। স্ত্রীকে শুধু নির্দেশ দিয়ে নয়, স্ত্রীকে খুশি করতে কনকদাও খুব দ্রুত গুজরাতি ভাষা শিখে নিলেন।
কনকদা একটি ব্যতিক্রমী
এবং উদ্দমী চরিত্র। এসোসিয়েশনে ১৯৯৪ সালে কোষাধ্যক্ষপদে এবং ১৯৯৬ সালে সম্পাদক।
মাঝে কিছু বছর বাদ দিয়ে (২০০৪-২০) একনাগাড়ে ১৬ বছর এসোসিয়েশনকে একেবারে সামনে থেকে
নেতৃত্ব দেওয়া। দূরদর্শিতা, আত্মবিশ্বাস, প্রখর
স্মৃতিশক্তি, পরোপকারী, অদম্য
ইচ্ছাশক্তি, সৎ ,ব্যক্তিত্বসম্পন্ন
মানুষ। নেতা হওয়ার সমস্ত গুণ কনকদার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। যিনি ৬ ঘন্টা ঘুম বাদ
দিলে ১৮ ঘন্টা এসোসিয়েশন আর কালীবাড়ীর কথাই ভাবতেন।
গ্রামের পাশ দিয়ে চলে
যাওয়া কেলেঘাই নদী,
সোনার ধানের ক্ষেত পাশে রেখে, সবুজ সবুজ শাপলা
শালুক ঝিল পিছনে ফেলে, গোধূলির রক্তরঙ পশ্চিম দিগন্ত, আর
সন্ধ্যার জ্যোৎস্নাভরা প্রান্তর ছেড়ে -- সেই গ্রাম্য ছেলেটি একদিন স্বপ্ন
দেখিয়েছিল আমেদাবাদের বাঙালিকে। স্বপ্ন তো সবারই থাকে অন্তরে। কিন্তু শুধু স্বপ্নদেখানো
নয়, বাস্তবে তা করে দেখিয়েছিলেন কনকদা। আমেদাবাদ শহরে
বঙ্গজীবনে কনকদা ছিলেন একটি উজ্জ্বল গতিময় আলোকশিখা। যে আলো ফুটেছিল রূপ হয়ে,
তা কেবল বহিরঙ্গে ছিল না, তার অন্তরেও ছিল এক
প্রজ্জ্বল প্রদীপের শিখা -- বেঙ্গল কালচারাল এসোসিয়েশনের জন্য। আজীবন দীপ্ত হয়ে
নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিবেদন করে গেছেন। সত্যিই
এমন জীবন বিরল, যে সর্বাংশে ধুপের স্নিগ্ধ
সুগন্ধ দিয়ে গেল শুধুমাত্র বেঙ্গল
কালচারাল এসোসিয়েশন আর কালীবাড়ী নির্মাণে।
চলার পথে অনেক মানুষ
পেয়েছিলেন যারা তার স্বপ্নকে তরান্বিত করতে সাহায্য করেছিলেন। এই স্বল্প পরিসরে
তাদের সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবুও কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। একেবারে
শুরুর দিকে শ্রী রবি দত্ত,পরের দিকে শ্রী প্রবীর বাসু (IAS), শ্রী প্রভাত ঘোষ (IAS), শ্রী শিবশঙ্কর চ্যাটার্জী,
শ্রী শম্ভুনাথ চক্রবর্তী, শ্রী খগেন গুহরায়,
শ্রী সমীর সেনগুপ্ত প্রমুখ।
বহু মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ব্যতীত কালীবাড়ী নির্মাণ প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু যে দুজন মানুষের ভূমিকা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে একজন কনকদা, অপরজন অনলদা। অনল মুখার্জী। কনকদার গত ৩৬ বছরের ছায়াসঙ্গী। কনকদার চরিত্রের বজ্রকাঠিন্যের অন্তরালে নিহিত ছিল এক কুসুম কোমল হৃদয়। বারবার আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। কতবার কনকদা তার পরম বন্ধু, এসোসিয়েশনের মঞ্চে তার অন্যতম সহকর্মী অনলদার কথা বলতে গিয়ে শিশুর মতই হাউ হাউ করে কেঁদেছেন।
কনকদা ছিলেন পুরোদস্তুর
মনেপ্রাণে বাঙালি। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা সত্বেও বাংলা ভাষা, বাংলা
খাওয়াদাওয়াতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কনকদার মধ্যে একটা শৈল্পিক দিকও ছিল।
মাত্র কয়েক বছর আগের ঘটনা। কালীবাড়ী প্রাঙ্গণে রবীন্দ্র-জয়ন্তী উৎসব। কনকদা বলল,"চল,এবার মঞ্চ সাজাব ছাতিম (সপ্তপর্ণী) গাছের পাতা
দিয়ে। ছাতিমতলা, শান্তিনিকেতন , রবিঠাকুর।
অন্তরের সম্পর্ক। কি বল।" বিকেলে আমাকে নিয়ে গাড়িতে বেরোলেন। পথের ধারে ছাতিম গাছের পাতা কেটে নিয়ে
এলাম। বাঁশ কেটে মঞ্চের পিছনে দেওয়াল তৈরি করে ছাতিমগাছের পাতা জুড়ে দেওয়া হল।
মাঝখানে রবিঠাকুরের ছবি। সেবার কনকদার ভাবনায় তৈরি হল এক অভিনব রাবীন্দ্রিক পরিবেশ।
বর্তমান আমেদাবাদে আসতে
থাকা নতুন বাঙালি জানুক, নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য কেমন
করে একটি প্রাণকে ফুলের সুগন্ধের মতো ছড়িয়ে দিতে হয় এবং বেঁচে থাকার প্রকৃত
সার্থকতা কিভাবে নিহিত থাকে।
১৬ই মার্চ ২০২০। বাঁধন
গেল ছিঁড়ে। পাখি গেল উড়ে, মুক্ত গগনে। সুখময় নীড় রইল পড়ে। যে নীড়ে পড়ে রইল
স্ত্রী, দুই পুত্র,পুত্রবধূ আর অতি
আদরের নাতনি। পড়ে রইল গ্রামের বাড়িতে অশীতিপর বৃদ্ধা মা, ভাইরা,
বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা। পড়ে রইল সাধের কালীবাড়ী। আর পড়ে
রইলাম আমরা তার অগণিত কাছের মানুষ।
"তোমাকে হারিয়ে আমরা মেনেছি,
নিয়তির কাছে হার।
ভুলিনি কিছুই স্মৃতিগুলি তব,
মনে পড়ে বারবার।"
No comments:
Post a Comment