ভাষা তুমি কার?
ডা০ (ক্যাপ্টেন) দিলীপ কুমার সিন্হা,
পাটনা
সৌমিত্র সিংহ। মাতৃ ভাষা বাংলা। পিতার
কর্মসূত্রে বিহারে জন্ম। বিহারে শিক্ষা। বিহারে চাকরী। বিহারে বিয়ে। অবশ্যই প্রেম
করে। বাঙালি মেয়ে। বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় প্রেম নিবেদনের কথা বোধহয় ভাবতে পারেন নি।
বিহারে বাড়ি করেছেন। কিন্তু মনে প্রাণে বাঙালি। বাংলায় গান শোনেন। বাংলা খবর কাগজ
পড়েন। বাংলায় কথা বলতে ও মাতৃভাষার সপক্ষে কথা বলতে ভালবাসেন। বলেন পরদেশে নিজের
মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে যুদ্ধ করতে হলে করবেন। গর্দান দেবেন কিন্তু ভাষা দেবেন
না।
ছেলে
বিহারেই পড়েছে। সময়ের তাগিদে ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষা শুরু হোয়েছে। সেখানে
বাংলা পড়তে হয় নি শুধু ইংরাজি ও হিন্দি পড়তে হয়েছে তবে সৌমিত্র সিংহ ছেলের হাতেখড়ি
করিয়ে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় সামনে রেখে অ আ ক খ শিখিয়েছিলেন। বাংলায় কমিক বই
কিনে দিয়েছেন। বাংলার অক্ষর চিনিয়ে চিনিয়ে গল্প শুনিয়েছেন। অলিখিত আদেশ ছিল যে
বাইরে যে ভাষায় কথা বলুক না কেন বাড়িতে বাংলায় কথা বলতে হবে। বাড়িতে শুধু বাংলা
ভাষা শুনে ও কথা বলে, ছেলে পরিস্কার
বাংলায় কথা বলতে পারে, ঠেকে ঠেকে বাংলা পড়তে আর নিজের নাম বাংলায় লিখতে পারে।
এতদিন
পর্যন্ত ঠিক’ই চলছিল। তবে মুস্কিল বাঁধল ছেলে যাকে বিয়ে করল তার নাম রমা, একসঙ্গে
পড়ত, একই অফিসে কাজ করে তবে মাতৃভাষা হিন্দী। জোড়ে প্রণাম করতে এসে পুত্রবধু বলল, - "মেরা মাতৃভাষা তো হিন্দী হৈ, মুঝে বাংলা বোলনা নহি
আতী, লেকিন মুঝে শিখা দেনেসে মৈঁ বাংলা মেঁ
হী বাত করুঙ্গি। অন্য কেউ হলে হয়ত খুশি হতেন যে ছেলের নিজের পছন্দ’তে আনা পুত্র
বধু স্বেচ্ছায় নিজের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করতে রাজি আছে। কিন্তু মাতৃভাষা প্রেমী
সৌমিত্র সিংহের এই প্রস্তাব পছন্দ হল না। তাঁর মতে নিজের মাতৃভাষা’কে ভালবাসার
মানে নয় অন্য মাতৃভাষাকে মুছে দেওয়া। তাড়াতাড়ি পুত্রবধুর হাত ধরে বললেন- "না
মা, তুমি নিজের মাতৃভাষাকে ছাড়বে কেন। তুমি তোমার মাতৃভাষাতে কথা বল আমরা আমাদের
মাতৃভাষায় কথা বলব। আমার মনে হয়না কোন অসুবিধে হবে।" দুজনেই হেঁসে উঠলেন। বোধ
হয় ঈশ্বরও হাঁসলেন। সৌমিত্র সিংহের বাড়ির অন্দরমহলে তাঁর মাতৃভাষা বাংলা কে একটু
জায়গা পুত্রবধুর ভাষাকে ছাড়তে হল।
হয়ত
বউ’কে খুশি রাখতে বা সহকর্মী বৌএর উপর নিজের কর্তৃত্ব না ফলাতে বা অভ্যাস মত, ছেলে নিজের বউএর সাথে হিন্দীতেই কথা বলে। বাবা মাএর সঙ্গে দরকারী কয়েকটা
কথা বলা ছাড়া ছেলের আর বাংলা ভাষায় কথা বলার সুযোগ হয়না। ছেলের বিয়ের আগে সকাল
সন্ধ্যে চা খাবার সময়ে তিনজনে বেশ গল্প হত। বাংলাতেই হত। রবিবারে রাত্রে টিভি তে
বাংলা সিনেমা দেখা হত। ইদানিং দুটো দল হয়ে গ্যেছে। পুরান স্বামী স্ত্রী শোবার ঘরে
বসে চা খান, আনন্দ বাজার খবরের কাগজ পড়েন, আর বাংলায় জী টিভি দেখেন। আর অফিস ফেরত নতুন স্বামী স্ত্রী নিজেদের
বেডরুম’এ চা খান আর হিন্দি সিনেমা বা সিরিয়াল দেখেন। দুই ভাষার দুই গ্রুপ, কোন
দ্বন্দ নেই, সহজ সহঅস্তিত্ব। বিশেষ কোন অসুবিধে হচ্ছিল না।
বছর দুএক এ
ভাবে কাটল। হটাৎ একদিন বিকেলে, তাঁদের পুত্রবধু রমা ও ছেলে, বিকেলে বার হল একটু
সেজেগুজে। শাশুড়িকে বলে গেল যে মন্দিরে যাচ্ছে পুজো দিতে, একটা ভাল খবর আছে এসে
জানাবে। ফিরল ঘন্টা খানেক পরে। বেশ হাঁসি খুশি সঙ্গে বড় প্যাকেটে সন্দেশ। এসেই
শ্বশুর শাশুড়ির পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। ছেলে সন্দেশের প্যাকেট টা বাবার দিকে
এগিয়ে দিযে বলল - "তুমি সন্দেশ ভালবাস, যটা ইচ্ছে খেয়ে নাও, রাত্রে ডায়াবেটিস
এর ট্যাবলেট একটা বেশি খেয়ে নিও।" আনন্দে ডগমগ রমা তাড়াতাড়ি নিজের স্বামী’কে
একদিকে টেনে বলল "আরে বাবা কো বতাইয়ে না কি ওয়ে দাদা বন্নে বালে হৈঁ"।
সোমিত্র সিংহ ব্যাপার কিছুটা আঁচ করেছিলেন। এখন সানন্দিত পুত্রবধুর মাথায় হাথ রেখে
আশীর্বাদ করে বললেন - "ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তোমার সন্তান সুস্থ হোক,
আয়ুষ্মান হোক, বিদ্বান হোক তবে আমি তো দাদা
হতে পারব না মা, কারণ দাদা একজনই, সে সৌরভ গাঙ্গুলী, তবে আমি দাদু হব। সবাই
হেঁসে উঠল।
সেদিন থেকে হটাত বাড়িতে জাদু হয়ে গেল।
আজকাল কেউ একলা বসে না। সবাই এক সঙ্গে বসেই কথা বলে, সবাই নিজের পছন্দমত, আগামী
দিনগুলি সাজাতে থাকে। হবু দাদু তাঁর ছেলের জন্মের সময় কি করেছিলেন তার গল্প শুরু
করে দেন। প্রথমে শুরু করেন বাংলাতে, কিন্তু বৌমার উপর চোখ পড়ে গেলে হিন্দিতে বলা
শুরু করেন।
দিন সপ্তাহ মাস কেটে যেতে লাগল। হটাৎ একদিন দাদুর মনে একটা চিন্তা এসে
ঢুকল। তার দ্বিতীয় প্রজন্ম কি ভাষায় কথা বলবে? নিজের মাতৃভাষা না তাঁর মাতৃভাষা।
প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে সে তার মাতৃভাষাতেই বলবে। তাহলে কি তাঁর আর তাঁর স্ত্রীর
অবর্তমানে এই ঘর থেকে বাংলা ভাষা শেষ হয়ে যাবে? কিছু কি করা যায়না যাতে আগত শিশু
তাঁর পিতৃ পুরুষের ভাষা, বাংলা ভাষা, অন্তত বুঝতে ও বলতে পারে? এই সবের উপায় ভাবতে
ভাবতে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ও এসে গেল যেদিন সন্ধ্যা বেলা বৌমা কে নিয়ে সৌমিত্র সিংহ,
তাঁর স্ত্রী, ও ছেলে নার্সিং হোমে গেলেন৷ পরদিন সকালে সুন্দর ফুটফুটে নাতনি কে কোলে
নিয়ে ফিরলেন। তারপর স্বপ্নের মত ছমাস কেটে গেল।
প্রায় প্রতিদিনই ঘর ভর্তি লোক, তাঁর স্ত্রী ও তিনি ছাড়া হাতে গোনা কয়েক জন
মাত্র তাঁর নাতনিকে বাংলাতে সম্বোধন করে। সৌমিত্র সিংহ কিন্তু কিছুতেই বুঝতে
পারছিলেন না যে কিভাবে অবাংলা ভাষার আধিক্যের এই পরিবেশে শিশুর বোধশক্তির মাঝে
বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। একদিন তাঁর স্ত্রী, নাতনি
কে তাঁর কোলে দিয়ে বললেন "নাও নাতনি কে চুপ করাও ত, কেঁদেই চলেছে"।
সাগ্রহে কোলে নিলেন, দোল দোল করলেন কিন্তু নাতনি তবু চুপ করে না। তাঁর স্ত্রী দাঁড়িয়ে দেখছিলেন।
হেঁসে বললেন শুধু দোলালে হবেনা একটু গান টান গাও। স্ত্রীর কথা শুনে হটাত মাথায়
একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি মোবাইল বার করে, গুগুলে গিয়ে "চাঁদ উঠেছে ফুল
ফুটেছে কদম তলায় কে, হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে সোনামনির বিয়ে" রাইম টা বাজিয়ে
বার বার শোনাতে লাগলেন। আশ্চর্য তাঁর নাতনি চুপ করে গেল আর তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তাঁর
স্ত্রী দুধের বোতলটা দিয়ে বললেন মুখের কাছে ধরত, দুধ টা খেয়ে নিতে পারে। সত্যিই
দুধ টানতে লাগল। দুধ শেষ করে উম আম করে দাদুকে কিছূ কথাও বলল। সৌমিত্র সিংহ বুঝতে
পারলেন রাইমস বা ইন্সট্রুমেন্টস এর ছন্দ, নাতনির মস্তিস্কের কোন জায়গায় একটা
কমফোর্ট জোন তৈরি করতে পেরেছে আর এই যদি
সত্যি হয় তাহলে হয়ত এই পথেই নাতনির বোধশক্তির মাঝে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা
করা যেতে পারবে। সেদিন রাত্রে সৌমিত্র বাবু নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমালেন। পরদিন থেকে
শুরু করলেন মনে করতে ছোটবেলাকার ভুলে যাওয়া ছড়া গুলোকে তারপর তাদের রেকর্ড যোগাড়
করতে বা ইউটিউব এ খুঁজতে। নিজের মোবাইলে ডাউনলোড করলেন আতা গাছে তোতা পাখি ডালিম
গাছে মৌ, খোকন খোকন করে মায়ে, আয়ে রে আয় টিয়ে নায়ে ভরা দিয়ে, তাই তাই তাই মামা
বাড়ি যাই, হাট্টিমাটিম টিম। নাতনি কে দুধ খাওয়ান আর তাকে গান শোনান সৌমিত্র বাবুর
নেশা হোয়ে দাঁড়াল।
একদিন
নাতনি তার মায়ের কাছে দুধ খাবে না আর দুদু দুদু বলে কান্না জুড়ে দিয়েছে। তার মা
তাড়াতাড়ি তার মোবাইলে হিন্দি রাইম খোজা শুরু করল খুঁজে পেল 'চন্দা মামা দূরকে পুরী
পকায়ে গুড়কে' কিন্তু সৌমিত্র বাবুর নাতনির কান্না বন্দ হয় না ওর মাথায় ত দুধের
স্বাদের সঙ্গে 'চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে', ঘর করে আছে। অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে আর
কতক্ষন বাচ্চার জিদের সঙ্গে লড়বে? দুম দুম করে এসে দাদুর কাছে বসিয়ে বলল - "বাবা
আপ মোবাইল সে বাংলা গানা শুনাতে শুনাতে ইসকা আদত করওয়া দিয়ে হৈঁ। আওউর কুছ
সুনানেসে শুনতা নহি হৈঁ। কেওল বাংলা গানা কা আদত বন জানে সে, ফির তো মেরে বেটি মেরে সাথ বাত হি নহী করেগী"। সৌমিত্র বাবু চুপ করে
শুনলেন। তারপর হাত জড়ো করে বললেন "না মা তোমার ভয় নেই, সন্তান মাতৃভাষা শিখবে
না এমন সম্ভব হতে পারে না। তোমার মুখের ভাষা শুনেই তো সন্তান ঘুমাবে, তোমার মুখের
ভাষা শুনেই তার ঘুম ভাঙ্গবে। তোমার ভাষাতেই সে স্বপ্ন দেখবে। তুমি যদি তোমার ভাষা
না বদলাও, তোমার সন্তান কি কখনো তোমার ভাষা ভুলতে পারে? আমি’ ত শুধু তার অন্তরমনে,
তার পিতৃ ভাষার জন্যে কিছু স্থান তৈরি করার চেষ্টা করছি। আমার হারিয়ে যাবার ভয়
আছে, তোমার সে ভয় নেই"।
দাদুর ছড়ার
ভান্ডারে এবার থেকে বাংলার সাথে তাল বজায় রাখতে কিছু হিন্দি ছড়াও যোগ হল 'মছলী জল
কি রানী হৈ জীবন উসকা পানি হৈ' অথবা 'অক্কর বক্কর বম্বে বো অস্সী নব্বে পুরে সৌ'। দাদুর
সোনা মনির সব ছড়াই ভাল লাগে তবে দুধ খেতে গেলে কিন্তু চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে চাইই
চাই। সবাই হাঁসত আর বলত মেয়ের বুদ্ধি ভাল, এখন থেকেই বিয়েতে কি কি হবে ঠিক করে
রেখেছে। বছর তিনেক বয়েস হল। সোনা মনির
মাথার মধ্যে ছোট ছোট শব্দ গুলি তৈরী হচ্ছে, তাই দিয়ে ফুট ফুট কথা বলে দাদুর সঙ্গে। সৌমিত্র বাবু
নাতনির সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলেন আর নাতনি নিজের পছন্দ মত শব্দে উত্তর দেয়। বাংলা
কি হিন্দি বলা শক্ত। তবে মা বাবা আর আয়ার কাছ থেকে নিরন্তর হিন্দি শুনতে শুনতে,
নিজের মনের অভিব্যক্তি গুলি ব্যক্ত করতে হিন্দি শব্দ গুলিই অবচেতন ভাবে জীভের কাছে
চলে আসতো তাই হিন্দির টান টাই বেশি থাকত।
সোনামনির
কিন্ডারগার্ডেনে ভর্তি হবার বয়স এসে যাওআর সঙ্গে সঙ্গে যোগ হল আর এক নতুন ভাষা।
শেখান শুরু হল, 'হোআট ইজ ইয়োর নেম, হোআট ইজ ইয়োর ফাদার্স নেম, হোআট কালার ইজ দিস'।
ছোট্ট মেয়ের ছোট্ট মাথায় মাতৃ ভাষা হিন্দি, পিতৃ ভাষা বাংলা ও সভ্য স্কুলের ভাষা
ইংরিজি, নিজের নিজের স্থান স্থির করবার চেষ্টায় বেচারী’কে প্রায়ই অস্বস্তিতে ফেলে
দিত। মাঝে মাঝে তাই দাদু ও থাম্মার কাছে এসে কোল ঘেঁসে বসে বলত "দাদু
চাঁদওয়ালা গানা শুনাও তো"। তারপর চলত দাদু থাম্মা আর নাতনির আড্ডা। ভাষাবিদদের এই আড্ডায় ঢোকা মানা
ছিল।
এখন আদরের নাতনির বয়স হল পনের বছর অনেক বন্ধু, অনেক পড়া, তিনজন টিচারের কাছে টিউশন নিতে যেতে হয়, আশি বছরের দাদু আর আঠাত্তর বছরের থাম্মার সঙ্গে আর আড্ডা মারার সময় পায় না, তবে সকালে গুড মর্নিং আর রাত্রে শোবার আগে সুইট ড্রিম নিশ্চয় করে বলতে আসে। কখনো যদি হটাৎ কিছুক্ষণ কথা বলার আয়েসি সময় পওয়া যেত তাহলে তা হত আশি ভাগ ইংরেজি, উনিশ ভাগ হিন্দি আর হয়ত এক দুটি শব্দ বাংলায়। সৌমিত্র বাবু বুঝেছিলেন যে, মানুষ যে ভাষা দিনের পর দিন বেশির ভাগ সময়ে শুনবে ও ব্যবহার করতে বাধ্য হবে, তার মস্তিষ্ক তার ভাবকে ব্যক্ত করতে সেই ভাষাকেই যুগিয়ে দেবে, সেই ভাষাতেই সম্পৃক্ত হবে, এই সত্য আর এর থেকে মুক্তি নেই। তবু মাঝে মাঝে ভাবতেন তাঁর মাতৃভাষাকে পরের প্রজন্মের মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখার তাঁর এত প্রচেষ্টা কি তবে ব্যর্থই গেল? এই কথাটা তাঁর মনে এলেই বুকের কাছে কেমন যেন লাগত।
সৌমিত্র বাবু ডায়বেটিক ছিলেন। মাঝে মাঝে রাত্রে ভুলে দুবার ওষুধ খেয়ে ফেলতেন, আর ব্লাড সুগার কমে যাওয়া তে অজ্ঞানের মত হয়ে পড়তেন। সেদিন ভোরে হটাৎ বেশি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। পাশে শুয়ে থাকা থাম্মা সামলাতে পারছিলেন না। নাতনির নাম ধরে জোরে ডেকে উঠলেন, সোনামনি দৌড়ে এল, ছেলে পুত্রবধু দৌড়ে এল, তাড়াতাড়ি গ্লুকোজ গুলে বড় চামচে করে দাদুর গলার নিচে পর্যন্ত ঢেলে দিতে চেষ্টা করল, কিন্তু সৌমিত্র বাবুর মানসিক সচেতনতা অনেক কম হয়ে যাওয়াতে গিলতে পারলেন না। কোন কিছুই কাজ করছিল না। থাম্মা সোনামণির হাত ধরে বললেন তুমি ত দিদিভাই দাদুর প্রাণ ছিলে, তুমি চেষ্টা করে দেখ না একবার, তোমার ডাকে দাদু ফিরে আসে কিনা। সোনামণি একবার থাম্মার দিকে তাকিয়ে দেখল তারপর হটাৎ দাদুর মাথাটা কোলে টেনে নিয়ে তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জোরে জোরে গেয়ে উঠল "চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদম তলায় কে ? হাতি নাচছে , ঘোড়া নাচছে সোনামনির বিয়ে, "কিছুই হল না, দ্বিতীয় বার গাইল আরো জোরে, এবার মনে হল দাদুর চোখের পাতা একটু নড়ছে, আবার গাইল। হঠাৎ বড় চামচের গ্লুকোজ জলটা গিলে ফেললেন, তার পরে আরেক চামচ, তারপর আরো কয়েক চামচ। জ্ঞান একটু একটু করে ফিরে আসতে লাগল, পরিস্কার শুনতে পেলেন, খুব চেনা কোন গলা জোরে জোরে তাঁকে বলছে, "দাদু চোখ খোল, চোখ খোল, তুমি ঠিক হয়ে গেছ, মুখ খোল, জলটা খেয়ে নাও" দাদু আস্তে আস্তে চোখ খুললেন, নাতনিকে দেখলেন, মুখ হাঁসিতে ভরে উঠল। নাতনির হাত দুটো ধরে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কি দিদিভাই তুমি বাংলা ভোলনি? তুমি বাংলা বলতে পার?" দিদিভাই দাদুভাইকে দুহাতে জড়িয়ে, বুকে মুখ রেখে বলল "হ্যাঁ শুধু তোমার জন্যে”।
********
No comments:
Post a Comment