বাইশে শ্রাবণ: বিনম্র স্মরণে
ঐ নীলরঙ ইনল্যান্ড খামটার কথা মনে পড়ে গেল। পূর্ণিয়ার নীতিন বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের শ্রদ্ধেয় ফটুদাকে লিখেছিলেন প্রবাদ প্রতীম দেবব্রত বিশ্বাস। খামটির পেছনের দিকের পাতায় জর্জ বিশ্বাস ছবি এঁকেছিলেন। অনেক দিন আগে দেখলেও মনে আছে ছবিটা। একটি বিশাল বৃক্ষ। তার প্রচুর শাখা প্রশাখা।সেই বিরাট গাছে বসে আছে একটি কাক। পাখিটিকে গাছের তুলনায় খুবই ছোট দেখাচ্ছে। দেবব্রত লিখেছেন ‘ নীতিন বাবু ঐ বিশাল গাছটি রবীন্দ্রনাথ। গাছে বসে থাকা ছোট্ট পাখিটি আমি। আমি তাঁর আশ্রয়ে বসে আছি কিছু পাব এই প্রত্যাশায়।’
বুদ্ধদেব
বসুর কাছে যাই। সঙ্গ নি:সঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ এই বইটিতে লিখছেন ‘কি?
রবীন্দ্রনাথ নেই?
এ কি সম্ভব ? তাহলে
আমাদের দু:খের দিনে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো আমরা? কে আমাদের
ভালবাসবেন,আমাদের শাসন করবেন? স্বদেশের
সংকটের সময় কে আমাদের উপদেশ দেবেন? জগৎটাকে এনে দেবেন আমাদের
দরজায়? আমাদের জীবনে ও প্রতিষ্ঠানগুলিতে অর্পণ করবেন শ্রী ও
মর্যাদা ?’ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কলকাতা শহর কার্য্যত সেদিন। সমস্ত
যানবাহন বন্ধ। ফুলের দোকানের ঝাঁপ ফেলা। দক্ষিণ কলকাতা থেকে কাতারে
কাতারে মানুষ হাটতে হাটতে চলেছেন। গন্তব্য সকলের সেই এক জোড়াসাঁকো।একই উদ্দেশ্য
সকলের অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন। চোখের দেখা। সেদিন বাইশে শ্রাবণ। ১৩৪৮। সেদিন ৭ ই
আগস্ট।১৯৪১।
সত্যজিৎ
রায়ের ডকুমেন্ট্রি ‘রবীন্দ্রনাথ’ শুরু হয়েছে কবির
প্রয়াণ দৃশ্য দিয়ে। স্মরণ করি সেই মেঘমন্দ্র স্বরটিকে।তথ্যচিত্রের ধারাভাষ্যকার যে
সত্যজিৎ। তাঁর অননুকরণীয় উচ্চারণে বলে উঠলেন
On the 7th of August, 1941, in the city of Calcutta.
A man died. His mortal remains perished. But
he left behind him a heritage which no fire could consume. It is a heritage of
words, of music and of poetry, of ideas and ideals. It has a power to move us, to
inspire us today and the days to come. We owe him so much. Salute his memory.
৩০ শে জুলাই
১৯৪১। সেদিন কবির অপারেশন।সার্জেন ডাক্তার ললিত ব্যানার্জি। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। সময়
সকাল ১১টা। স্বভাবতই কবির শরীর ভালো নেই। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীল মন ?
কবি সেদিন
বেশ সকালে একটি বড় কবিতা লিখলেন। মুখে মুখে বলে গেলেন। রাণী চন্দ লিখে রাখলেন। সই
করলেন কাঁপা হাতে - বাবামশায়। রচিত হল ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ কবিতাটি। কবিতার বেশী অংশ সকালে লেখা। শেষ তিন লাইন সংযোজন হয় সকাল সাড়ে
নটায়। অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে। সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার। অপারেশনের
জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় কবিতাটি শুনতে চাইলেন। মন:পূত হল না। কিছু গোলমাল আছে। কবি
বল্লেন ডাক্তাররা বলেছে অপারেশনের পর আমার মাথা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভাল হয়ে
ঠিক করবখন। না ঠিক করা হয়নি।
সেদিন সকাল
১০ টা।এই কবিতাটি লেখার পর লিখলেন একটি চিঠি। পরম স্নেহের পুত্রবধূ প্রতিমা
দেবীকে। মুখে বলে গেলেন চিঠির বয়ান। ডিকটেশন।
একটু পরেই
স্ট্রেচার এল। কবিকে নিয়ে আসা হল অপারেশন টেবিলে। লোকাল এ্যানেসথেসিয়া। ২০ মিনিট
সময় লাগল সার্জারি করতে। কি দিয়ে তৈরী রবীন্দ্রনাথ ? আমি
চিন্তায় পড়ে যাই। সকালে অপারেশন হবে আর সেই সকালেই সৃজন?
২৭ শে জুলাই
১৯৪১।দিনটির কথা আপনাদের বলতে ইচ্ছে করছে।
২৫ শে জুলাই
কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকো নিয়ে আসা হয়। অত্যন্ত অসুস্থ, দুর্বল।
কিন্তু এই অবস্থায় ২৭ শে জুলাই লেখা হল ‘প্রথম দিনের
সূর্য্য প্রশ্ন করেছিল। সত্ত্বার নতুন আবির্ভাবে।
কে তুমি ?’ রাণী
লিখে রাখেন। কবি বল্লেন ‘প্রত্যেকবার ভাবি ঝুলি খালি হয়ে
গেল। এবারে চুপচাপ থাকি। কিন্তু পারিনে।’ সত্যিই পারেন নি। নাহলে
দেখুন না। ২৯ শে জুলাই বিকেল বেলা লিখে ফেল্লেন ‘দু:খের
আঁধার রাত্রি বারেবারে। এসেছে আমার দ্বারে।’ লিখে রাখেন রাণী
কবির মুখে রচিত কবিতাখানি।
একটু ২৫ শে
জুলাই তারিখটিকে ছোঁয়া যাক। রবীন্দ্রনাথ ভালো নেই। কদিন পরেই এসে দাঁড়াবে ৭ই
আগস্ট। বেজে উঠবে কালের ঘন্টাধ্বনি। ঘড়ির কাঁটা জানান দেবে। বেলা ১২ টা বেজে ১০
মিনিট। কবিকে ২৫ তারিখ শান্তিনিকেতন থেকে চিকিৎসার জন্যে জোড়াসাঁকো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।ইজিচেয়ারে
শায়িত কবি। আশ্রমিকদের চোখে জল। তারা কবির পাশে গাইছে ‘আমাদের শান্তিনিকেতন।’ গ্রামের লোকেরা বোলপুর স্টেশনে নিয়ে যেতে কবির যাতে ঝাঁকুনি না লাগে তাই
আগের রাতে রাস্তার খানাখন্দ গর্তগুলোকে ভরে বুজিয়ে দিয়েছেন।
কবি হয়ত
সঙ্কেত ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন। আর কোনদিন শান্তিনিকেতন ফেরা হবে না। তাই আজ তিনি
কালো পোশাকে, চোখে কালো চশমা, মাথায় কালো
টুপি পড়ে আছেন। গাড়ি চলেছে বোলপুর স্টেশনে। ওখানে প্রতীক্ষারত সেলুনকার।নম্বর EIR
- 2377.পাকুড় প্যাসেন্জারের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনায়
ছিলেন রেলওয়ে বিভাগের Chief Operating Superintendent শ্রী নিবারণ চন্দ্র
ঘোষ। হাওড়ায় ট্রেনটি পৌঁছয় ২ টো ৪০এ। কলকাতায় কবির আসার খবর প্রচার করা হয় নি। তাই
ভীড় জমা হয়নি স্টেশনে।
একটা উত্তর
পেয়ে গেলাম। কি করে তিনি রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন ? গুণীজনের
বিশ্লেষণ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মত পিতা হলে রবীন্দ্রনাথের মত ছেলে হয়। আসলে
রবীন্দ্রনাথ মানেই প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা। তাঁকে জীবনের চলার পথে বিভিন্ন
বয়েসে সুখে দু:খে আলো অন্ধকারে নানা রঙে পাওয়া। আমাদের জীবন যে কোন সঙ্কট
মোকাবিলায় তৈরী হয়ে যায়। আমাদের একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন। তাই না ?
তাই তো কখন
যেন ২২ শে শ্রাবণ, ২৫ শে বৈশাখ হয়ে যায়।
আসুন
বিশ্বজোড়া এই সঙ্কট কালে আমরা সকলে ঐ বটগাছটির আশ্রয়ে দাঁড়াই। পবিত্র মন্ত্রের মত
উচ্চারণ করি মৃত্যু জীবনের শেষ কথা নয়। জীবনই জীবনের শেষ কথা বলে।
অন্তরের
শ্রদ্ধায়, প্রণামে
অজয় সান্যাল।
No comments:
Post a Comment