শহীদ
ক্ষুদিরাম
তাঁর বয়েস হয়েছে। প্রায় নব্বই। শ্রদ্ধেয় অরুণ কুমার রায়। কিন্তু আজ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অবাক হলাম। মোবাইল বাহিত কন্ঠস্বর আজ যে কোন তরুণ যুবকের মত দীপ্যমান। উজ্জীবিত গলায় বলছিলেন বাবার কথা। প্রসঙ্গ সেই মৃত্যুজয়ী কিশোর ক্ষুদিরাম। বাবা জীতেন্দ্রনাথ রায়কে জীতুবাবু নামেই চিনতেন মুজ:ফরপুরের পরিচিতজনেরা। ক্ষুদিরাম তখন মুজ:ফরপুর জেলে বন্দী। জেলে তাঁকে দেখতে যেতেন মাঝে মাঝে ক্ষুদিরামের উকিল তাঁর সঙ্গী হয়ে। বাড়ি ফিরেই স্ত্রী তরুবালাকে আবেগরুদ্ধ গলায় বলতেন, ‘তরু দেখে এলাম ঐ কিশোরটিকে। কি প্রশান্ত মুখমন্ডল। আহা কি আভা চোখেমুখে। অসমসাহসী। মৃত্যুভয় কাকে বলে ও জানে না তরু।’ মাকে জেলবন্দী ছেলেটির কথা বলতে গিয়ে গলা ভেঙ্গে আসত বাবার। বয়স্ক মানুষটি আটকাতে পারতেন না নিজেকে। ক্ষুদিরামের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন জিতেন্দ্রনাথ। আজই সেই দিন। লিখছি। বাইরে সন্ধ্যের অন্ধকার। রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছে। ১১ই আগস্ট ১৯০৮।
প্রভাতী সূর্য্যর আলো ছড়িয়ে পড়েছে মজ:ফরপুর শহরের আকাশে। একটি অমূল্য
জীবন ঘিরে নেমে আসছে সূর্য্যাস্তের ছায়া। ইতিহাসের
পাতায় লেখা হবে সময়ের সঙ্কেত ধ্বনি। মহাকালের হিসেব।ঘড়ির কাঁটায় সময় সকাল ছটা। সেদিন
যন্ত্রণায় বিদ্ধ সাত সকালে পাঁচটায় দুজন বাঙ্গালি জেলের সামনে এসে পৌঁছন। ভেতর ঢোকার
অনুমতি এই দুজন বাঙ্গালি পেয়েছিলেন। বেঙ্গলি কাগজের সংবাদদাতা ও উকিল উপেন্দ্রনাথ বসু
আর ক্ষেত্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্নান সারা।হেঁটে আসছেন অকুতোভয় কিশোর। বয়েসের হিসেবে
উনিশ হয়নি তখনো। দুজন বাঙ্গালিকে দেখে হাসলেন। বাকিটা ইতিহাস। ইতিহাসের পাতা কথা বলে।
জেলের বাইরে আনা হয়েছে তাঁকে। এখন আর তিনি কোন কথা বলবেন না। ব্রিটিশ বিচারককে যেমন
একদিন বলেছিলেন। আদালতে যেদিন বিচারক কর্নডফ ফাঁসীর দিন ১১ ই আগস্ট ঘোষণা করেন। ক্ষুদিরাম
বিচারককে বল্লেন ‘একটা কাগজ আর পেন্সিল দিন। আমি বোমার চেহারাটা এঁকে দেখাই। অনেকেরই
ধারণাই নেই ঐ বস্তুটি দেখতে কেমন।’
এগারোই আগস্ট। সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা মজ:ফরপুর। শোকস্তব্ধ। পরের দিন শহরের ওরিয়েন্ট ক্লাবে একত্র হয়েছিলেন ডাক্তার জীতেন্দ্র নাথ ঘোষ, চারুচন্দ্র চৌধুরী, রামলাল চট্টাপাধ্যায় প্রমুখ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বেরা। ক্লাবের বাইরে ছিল মজুদ গোয়েন্দাবাহিনী। আশঙ্কা আজ সভায় আবেগের বহি:প্রকাশে যেন কোন ভয়ঙ্কর ঘটনা না ঘটে যায়।
পাটনায় আজ কথা বল্লাম ৯০ বছরের যুবক অরুণকাকুর সঙ্গে। মহান বিপ্লবী,
রাসবিহারী বসুর ঘনিষ্ট সহযোগী শচীন্দ্র নাথ সান্যাল তাঁর জ্যাঠামশাই। কাকু দৃপ্ত কন্ঠে
বল্লেন অমর শহীদ ক্ষুদিরামের কথা হোক। আমাদের জন্যে, দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা
ক্ষুদিরাম বাজি রেখে ছিলেন নিজের জীবন। ফৈজ আহমেদ ফৈজের শব্দে -
মেরী জিন্দগী রহগুজর হৈ
হর এক কো ফৈজ মিলে
মৈ চিরাগে রহগুজর হুঁ
মুঝে সৌখ সে জলাও
মুঝে সৌখ সে জলাও।
বিহার বাঙালি সমিতি, পূর্ণিয়া শাখার তরফ থেকে জানাই চিরভাস্বর শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর স্মৃতির প্রতি বিনম্র
শ্রদ্ধাঞ্জলি।
অজয়
সান্যাল
No comments:
Post a Comment