দ্বিশত-জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর ও আমাদের মাতৃভাষা: মহীদাস ভট্টাচার্য্য শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী বুদ্ধিজীবী মঞ্চ, কলিকাতা

 দ্বিশত-জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর ও আমাদের মাতৃভাষা

 


মহীদাস ভট্টাচার্য্য

শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী বুদ্ধিজীবী মঞ্চ, কলিকাতা


বিশ্বের কোনো কোনো দেশে এমন কিছু মহাপ্রাণের আবির্ভাব ঘটেছে যাঁরা উত্তরকালের প্রজন্মকে বাধ্য করেন তাঁদেরকে অনুসরণ করতে। বাংলা-ভাষাভাষীর সৌভাগ্য তেমনি। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই রকম এক মহাপ্রাণ। মৃত্যুর ১৩০ বছর পরেও নবীন উৎসাহে বঙ্গভাষীরা তাঁর স্মৃতি সামনে রেখে নিজেদের চলার পথটি নির্ধারণ করতে উদ্যোগী হয় স্বত:স্ফূর্ত প্রাণের আবেগে। বহু প্রতিষ্ঠান বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী পালন করছে এই কারণেই।  নন্দন কানন উদ্‌যাপন কমিটি, কার্মাটাঁড়, অল ইণ্ডিয়া বেঙ্গলি এসোসিয়েশন, নিউদিল্লী, ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি ও বিহার বাঙালি সমিতি যৌথভাবে এইরকম একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই উদ্যোগে সামিল হয়ে বিদ্যাসাগর তর্পণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বাংলার শিল্পী-সাংস্কৃতিককর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সদস্য হিসেবে আন্তরিকভাবে গৌরব বোধ করছি, অনুপ্রাণিতও বটে।

 

ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বহুধাবিস্তৃত কর্মযোগে আপাতভাবে ভিন্নতা থাকলেও এগুলির মধ্যে একটি সমন্বয়ের যোগসূত্র রয়েছে। সেটি হলো তাঁর মানুষের প্রতি অসীম মমত্ব ও নতুন মানুষ গড়ার স্বপ্ন। সবার উপরে মানুষ সত্য এটি প্রতিষ্ঠা করার আত্মবিশ্বাস তাঁকে অস্থির রাখত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই। চঞ্চল থেকেছেন আমৃত্যু। সামন্তীসমাজের জাতিধর্ম নির্বেশেষে প্রান্তিক মানুষের জীবনযন্ত্রণার পেছনে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস ও সে বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন কার্মাটরের আদি অধিবাসীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে। প্রতিকারের সন্ধানও ছিল তাঁর কাছে। বিশেষ করে পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে। কিন্তু তখন তিনি জীবন সায়াহ্নে।

ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাতে দেশের শাসনভার চলে যাওয়ার পর শুরু হল একটা অস্থিরতার যুগ। ব্যক্তি-মানুষের অস্তিত্ব নতুনরূপে প্রকাশ পেতে চাইছিল।  সমাজ অভ্যন্তরে এই অস্থিরতার কালে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছিলেন নতুন নাগরিক সভ্যতায়, যেখানে দুরাচার অনাচার, ব্যভিচার, নীতিহীনতার আধারেই গড়ে ওঠা বাবু-সংস্কৃতিতে ব্যক্তিকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখেছিল। অন্যদিকে সমাজমননে প্রাধান্য পেয়ে আছে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ইসলামী ভাবনা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য, বর্ণবিদ্বেষের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি । এই অবস্থায় ফরাসীবিপ্লবের উত্তর কালের কোলকাতার নতুন নগর সভ্যতায় তাঁর আগমন। পুরানো সবকিছুকে ভেঙ্গে নতুন কিছু একটা গড়ে উঠতে চাইছে সমাজ অভ্যন্তরে। তারই আকুতি অনুভব করেছিলেন গভীরভাবে কৈশোরে হিন্দুকলেজ ও স্কুল পরিবেষ্টিত সংস্কৃত কলেজের ছাত্রজীবনে। প্রাচ্যের পরিপূর্ণতার পাশে পাশ্চাত্যের ভাবনার একটা আঁচ পেয়েছিলেন। শিক্ষা অর্জনের উত্তরকালে সেগুলিই তাঁর জীবনের আদর্শের ভিত হিসেবে কাজ করেছিল। প্রাচীনত্বের বেড়াজাল থেকে পেরিয়ে তিনি আধুনিক মানুষ তৈরির কর্মযজ্ঞে ডুবে গিয়েছিলেন। 1841 থেকে তার যাত্রাশুরু যার পরিসমাপ্তি 1891-এ, জীবনের প্রায় শেষদিন পর্যন্ত। কার্মাটরের কর্মযোগ অন্তিম পর্বে।

কার্মাটরের জীবনের পেছনে নানাজন নানামত প্রকাশ করেছেন। প্রমথনাথ বিশী মনে করতেন “ঘরে বাইরে আঘাতে তিনি নাকি মানুষ সম্পর্কেই অনাস্থাবাদী বা সিনিক হয়ে ওঠেন; মানববিদ্বেষী মিস্‌আ্যানথ্রোপ বললেও ভুল হয় না।” সুমিত সরকারের মতো ঐতিহাসিকও মনে করেন –বিদ্যাসাগরের শেষজীবনে কার্মাটরেই কাটিয়েছেন, সাঁওতালরাই ছিলেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী।“ (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য, ২০১১)। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। এ কথা ঠিক যে তিনি তাঁর জীবনের শেষকটা দিন সাঁওতালদের মধ্যে, এ দেশের আদি অধিবাসীদের কাছে এক নতুন প্রাণের সন্ধান পেয়েছিলেন । কিন্তু কলিকাতার মুখ্য কর্মযজ্ঞের বাইরে থেকে তা নয়।

বিরক্ত হয়েছিলেন পরিবারের সদস্য, বীরসিংহের প্রতিবেশি, কোলকাতার বন্ধু ও সহযোগীস্থানীয়দের একাংশ,  দেশবাসীর একাংশের উপরেও। কারণ তারা সঙ্কীর্ণ সামন্তীমনোভাবাশ্রিত কুশ্রীতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চেষ্টাই করেনি। যেমন আজকের এই বিশাল দেশে একটা বিরাট অংশের মানুষ ধর্মীয় নিরপেক্ষতার সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে মেতে উঠেছে ধ্বংসের কর্মযজ্ঞে। তেমনি সেদিন বঙ্গবাসীর একটা অংশ সঙ্কীর্ণতাকে আশ্রয় করে উপকৃত হয়েও প্রবঞ্চিত করেছিল তাঁকে, সমাজের প্রয়োজনে কর্তব্যকে উপেক্ষা করেছিল। সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে উঠতে পারেনি। এতে তিনি যদি মানববিদ্বেষী হতেন তাহলে 1864-র মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশান, যেটি 1872-এ কলেজে রূপান্তরিত হয়, সেই প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক কর্মযজ্ঞে তাঁকে পাওয়া যেত কি? কার্মাটর ও কোলকাতা দুটোই নিত্য কর্মযোগের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সফল হয়েছিলেন তাতে। বিদেশি শাসকের আধিপত্যের বাইরে এসেও শিক্ষা সংস্কারে তাঁর উদ্যোগের সঠিকতা প্রমাণ করতে। মেট্রোপলিটনকে গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষিত দেশীয়দের নিয়ে। বিদেশীদের সাহায্য ব্যতিরেকেই সফল করে তুলেছিলেন সেই যুগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বিদেশি রেজিস্ট্রার বলতে বাধ্য হয়েছিলেন The Pundit has done wonders। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন সত্যিকারের জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই সময় তিনি কার্মাটরের জীবনের মধ্যেও ছিলেন। আরও নানা ঘটনা প্রমাণ করে তাঁর উভয়স্থলে কর্মযোগের ব্যাপ্তি। জীবনের শেষ মুহূর্তে নারায়ণ তাঁর কাছে ‘কী কষ্ট হচ্ছে’ জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেন “দু:খ হচ্ছে মেট্রোপলিটন স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের জন্য, চাকুরীজীবন অন্তে গ্রাসাচ্ছাদনের কোনও ব্যবস্থা করে যেতে পারলাম না।“ (ইন্দ্রমিত্র, ২০১৬, ৫৮২)

কার্মাটরের মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি দেশের প্রান্তিক জীবনের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিল।  সেটি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মনুষ্যত্ব ও  মমত্বের অসীমতার অনুরণন মাত্র। চঞ্চল করেছিল। বুঝেছিলেন ভারতীয় আর্য-আধিপত্যবাদী ও ইসলামী সামন্তীশাসক অধ্যুষিত সমাজ দেশেরই একদল মানুষকে অতি প্রান্তিকবাসী করে দিয়েছে। কার্মাটরে তাদেরই বাস। নতুন সভ্যতার বিকৃতি নগর ছেড়ে এই প্রান্তিক মানুষকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই তাদের সঙ্গে কাল কাটাতে চেয়েছিলেন তিনি। এটি তাঁর কর্মযোগে একটি নতুন সংযোগ। নগর কোলকাতায় সেদিন আজকের দলীয়-গণতন্ত্র গড়ে উঠেনি। ব্যক্তি বিদ্যাসাগর তাঁর কর্মযোগের ক্ষেত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন কার্মাটরকে। গড়ে তুলেছিলেন প্রান্তিক মানুষের মনন ও জীবনের সঙ্গে অতিপরিচিত  মানবপ্রীতির আদানপ্রদান। পরিপূর্ণতা পেয়েছে তাঁর কর্মযোগ। এখানকার সাঁওতাল ও প্রান্তিক অধিবাসীদের মধ্যেও তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন মানুষ তৈরির। গড়ে তুলেছিলেন স্কুল, মেয়েদের জন্যও। সান্ধ্য স্কুল। সেবায় ছিলেন কার্পণ্যহীন, সহায়তায় আজকের পুণ্যলোভাতুরদের মতো নয় মানবদরদী মন নিয়ে সময় অতিবাহিত করেছেন আনন্দের সঙ্গে । আদি অধিবাসীদের সহজ-সরল অকপট মননরীতি ও জীবনধারায় প্রাণের স্পর্শ পেয়েছিলেন, আকৃষ্ট করেছিল তাঁকে। এ দিয়েই তিনি মুখ্যধারার তথাকথিত আভিজাত্য ভেঙে প্রান্তিক ও উপেক্ষিত মানুষের সঙ্গে মানবতাবাদের ভিতের উপর প্রীতির সেতু রচনা পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন,  যা আজও অনেকের উপলব্ধিতে আসে না।

সামগ্রিকভাবে বীরসিংহের গ্রামবাংলার জীবনে, কোলকাতা নগরীর বিদেশি আধিপত্য,  রক্ষণশীল ও চতুর নাগরিক সমাজে  এবং কার্মাটরের প্রান্তিক মানুষের মধ্যে  নতুন যুগের মানুষ তৈরির আমৃত্যু কর্মযোগী ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যথার্থই আধুনিক ভারতীয় সমাজে ‘সবার উপরে মানুষই সত্যে’র উপাসক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানবতাবাদী ভাবনার পথিকৃৎ হিসেবে আমাদের সামনে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর শুরুকরা কর্মযোগের অসম্পূর্ণতা আজও এই স্বাধীন দেশে নতুন নতুন প্রান্তিকমানুষের জন্ম দিচ্ছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আবর্তে অতীতের প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও এই অগণিত অর্থনৈতিক ও উপেক্ষিত সঙ্কট জর্জরিত প্রান্তিক মানুষ। যেন তিনিই মানবদরদী নতুন মানুষ তৈরির আহ্বান জানাচ্ছেন, সক্রিয়ভাবে সাড়া দেওয়াই হবে স্মরণের তাৎপর্য

শিক্ষাসংস্কারে বাংলাভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলে তিনি মাতৃভাষার বিপন্নতা রক্ষা ও তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে ভাষা-উন্নয়নের একটি দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের সামনে রেখে গিয়েছেন। আজকের প্রেক্ষাপটে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে স্মরণ করে সেই বিষয়ে দু-একটি বিষয় আপনাদের সামনে উপস্থিত করব।

 

উৎস:

ভট্টাচার্য্য রামকৃষ্ণ। বিদ্যাসাগর নানা প্রসঙ্গ। চিরায়ত প্রকাশন। ২০১১।

ইন্দ্রমিত্র। করুণাসাগর বিদ্যাসাগর। আনন্দ। ২০১৬।

15-09-20

No comments:

Post a Comment

বর্ণপরিচয়