'নজরুল স্মরণে'
~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ
দ্বিতীয় পর্ব
আমাদের কবি নিজের জীবিত অবস্থাতেই নানা ভাবে অভিনন্দিত হয়েছেন -- 'বিপ্লবী কবি', 'চারণ কবি', 'প্রেমিক কবি', 'ধর্মভীরু মুসলমান কবি' আবার 'সুরের রাজা' আর 'ভোলা বাউল'-ও। অন্য দিকে বিরূপ আলোচনাও তাঁর ভাগ্যে কম জোটেনি। কখনো বলা হয়েছে -- 'শয়তানের পূর্ণাবতার', কখনো 'খোদাদ্রোহী', কখনো 'পাষন্ড', আবার 'মুসলমান রবীন্দ্রনাথ' নামেও নিন্দিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু লক্ষণীয় যে নানা ধরণের নন্দন ও নিন্দন - এর মাঝে আমাদের কবি কিন্তু সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে 'জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হাসতে - হাসতে' এগিয়ে গেছেন। নিজেই স্বীকার করেছেন, 'আজ সৃষ্টি - সুখের উল্লাসে ---- মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে, আজ সৃষ্টি - সুখের উল্লাসে।' এই আপোষহীন বিদ্রোহী কবি নজরুল আজও আমাদের অনুপ্রাণিত এবং অনুরণিত করে চলেছেন। অন্যায় - অসুন্দরের বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ আহবান আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে নতুন জীবনীশক্তিতে উদ্দীপ্ত করে তোলার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ বিশেষ।
গবেষকদের ধারণা অনুসারে ১৯২০ -র মার্চ থেকে ১৯৪২ -র জুলাই, মোট মাত্র ২২ বছর নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন হলেও আমরা ১৯২২ থেকে ১৯৩০, মাত্র ৮ বছরের সময়কালকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এই সামান্য সময়টুকুর মধ্যে তাঁর, অগ্নিবীণা (১৯২২), দোলনচাঁপা (১৯২৩), ভাঙার গান (১৯২৪), বিষের বাঁশী (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), সিন্ধু হিন্দোল (১৯২৬), সর্বহারা (১৯২৬), চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০) ও নজরুল গীতিকা (১৯৩০) সহ বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর পরেও তিনি লিখেছেন, যদিও সেগুলির মধ্যে প্রকৃতির ভিন্নতা রয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে এই পর্বের রচনাগুলি সেই যুগের প্রতীক হিসেবে আজও আমাদের বিস্মিত করে চলেছে। কবির ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতা আর বিদ্রোহ, কিংবা প্রেমের ক্ষেত্রে কবির অধীরতা, এই সমস্ত রচনাগুলিতে বাস্তব সত্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে।
আমাদের মনে রাখার দরকার যে ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে আমাদের কবির সর্বাধিক আদৃত 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশনার সঙ্গে - সঙ্গে অভূতপূর্ব জনসমাদর লাভ করে। এমনকি ২৩ বছরের এই যুবকের আলোচ্য রচনাটি সেসময় রবীন্দ্রনাথকেও মুগ্ধ করেছিল এবং নজরুলকে স্বীকৃতি দিতেও তিনি কোন কার্পণ্য করেননি। আমাদের কবির অন্যান্য কবিতাতে বিদ্রোহের ভাব দেখা গেলেও প্রধানত এই কবিতাটির জন্য নজরুল আজও 'বিদ্রোহী কবি' রূপে সমাদৃত হয়ে আসছেন। বলা চলে যে ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে 'অগ্নিবীণা' কাব্যে বিদ্রোহের যে সুর তৎকালে ধ্বনিত হয়েছিল, ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যে তার দেখা পাওয়া যায়নি, এই সুর আমাদের সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন বলেই আর নতুন বলেই রবীন্দ্র যুগের কবিদের মধ্যে তিনি এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হিসেবে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। নজরুল সম্বন্ধে বলতে গিয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছেন ---- "নজরুলকে 'বিদ্রোহী কবি' বলা হয় এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্টই বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধে যাবো, তখন সেখানে যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখন তাঁর গান গাইবো।" আসল কথা হলো এই যে নজরুলের কবিতা তখনকার তরুণ সমাজকে যতটা নাড়া দিয়েছিল, যুবা - মনকে যতটা আন্দোলিত করেছিল, ততটা অন্য কোন জনের লেখা করতে পারেনি। তিনি নিজে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, কারাগারে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, এই অভিজ্ঞতার প্রমাণ তাঁর রচনায় পাওয়া যায় এবং বলাই বাহুল্য, অন্য কোন বাঙালি কবির ভাগ্যে এমনটি জোটেনি। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন সমাজে ব্যাপ্ত অনিয়মের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অরাজকতা ও অসাম্যের বিরুদ্ধে। সমাজপতি সেজে যারা অন্যায় করেছেন, আমাদের কবির বিদ্রোহ তাদের বিরুদ্ধে আর ধর্মের ধ্বজাধারী মোল্লা - মৌলবী আর মোহান্তদের বিরুদ্ধেও। "মানুষেরে ঘৃণা করি', ও'কারা কোরাণ, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি! ও'মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক'রে কেড়ে, যাহারা আনিল গ্রন্থ - কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।", এছাড়া তদানীন্তন ইংরেজ শাসকদের প্রতিও তাঁর বিদ্রোহ বহু রচনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, নজরুল শুধু বিদ্রোহী নন, তিনি প্রেমিকও। "অনেকের ধারণা বিদ্রোহী কিংবা যোদ্ধার গলায় প্রেমের কথা ঠিক মানায় না। খুবই ভুল ধারণা। যোদ্ধারাই সম্ভবতঃ শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। পৃথিবীর যাবতীয় মহাকাব্য তার প্রমাণ দেবে।*** বীরত্বব্যঞ্জক এমন গান যা শুনলে কাপুরুষের রক্তেও আগুন ধরে যায় আর তার পাশাপাশি এমন মিঠে গজল, যা শুনলে বীর পুরুষের চক্ষুও একটি ললিত স্বপ্নের নেশায় আপনা থেকেই বুজে আসে। এই হলো নজরুলের ষোলো আনা পরিচয়। আট আনা বিদ্রোহ, আট আনা ভালোবাসা।"
No comments:
Post a Comment