'নজরুল স্মরণে' ~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ

 'নজরুল স্মরণে'

~ ড. আশিস্ কুমার সিংহ


তৃতীয় পর্ব


আমাদের মধ্যেকার জাতিভেদ প্রথা কবিকে মুহূর্তের জন্যেও স্বস্তি দেয়নি। এক্ষেত্রে একদিকে তিনি যেমন ব্যঙ্গ - বিদ্রূপের তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করতে কালক্ষেপ করেননি অন্য দিকে তেমনই মুসলমানদের ধর্ম - গৌরবকে অবলম্বন করে তিনি বহু বিদ্রোহমূলক কবিতাও লিখেছেন। আসল কথা হলো এই যে আমাদের কবির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মানুষ বসবে মানুষের আসনে, মানুষকে অসম্মান করে, অগ্রাহ্য করে কোন ধর্ম‌ই কখনো বড় হতে পারে না, বড় হয় না। কেন না, মানুষের জন্য‌ই ধর্ম এসেছে, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। "মানুষ এনেছে ‌ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোন।" আত্মপ্রত্যয়ী কবি নজরুল গুরুগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করেছিলেন, "মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্।" ঠিক এক‌ই কারণে নারী জাতিকে পুরুষ জাতির সমকক্ষীয় বলে মনে না করা, দূরে সরিয়ে রাখা আর নানাবিধ শাস্ত্রীয় গালভরা কথার জালে জড়িয়ে তাকে অগ্রাহ্য করাকেও কবি সর্বদা ঘৃণার চোখে দেখেছেন। উদাত্ত স্বরে বলেছিলেন, "সাম্যের গান গাই -- আমার চক্ষে পুরুষ - রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।



বিশ্বে যা - কিছু মহান্ সৃষ্টি চির - কল্যাণকর, অর্দ্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী, অর্দ্ধেক তার নর।" আবার সমাজে সর্বক্ষেত্রে নিন্দিত  বারাঙ্গনাকে মাতৃ সম্বোধন করে তার অন্তরস্থিত নারীত্ব এবং মাতৃত্বের প্রতি সম্মান দেখাতে তিনি কখনোই দ্বিধান্বিত হন নি। কবি লিখেছিলেন, "কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা, মা, কে দেয় থুতু ও - গায়ে?

হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতাসম সতী মায়ে।"

তিনি আরো বলেছিলেন, "অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তান ও তবে জারজ সুনিশ্চয়।"


ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও সাহিত্য -- সর্বত্র‌ই তিনি মানুষকে জাতি - ধর্ম - বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানবিকতার আদর্শে পূর্ণরূপে প্রকাশিত দেখতে চেয়েছিলেন। এই কারণে যেখানে নজরুল এগুলির দেখা পাননি, সেখানেই আমরা তাঁর বিদ্রোহকে রীতিমত জীবন্ত অবস্থায় পাই আর লক্ষ্যণীয় যে এর সঙ্গে প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়শীলতা একীভূত হ‌ওয়ার ফলে কবি দ্বিধাহীন কণ্ঠে কিছুটা বাধ্য হয়েই বলেছিলেন, "আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।" 


প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা এবং ধর্ম‌ ব্যবস্থার বিরোধিতা করাকে আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক বলে মনে হলেও এমন‌ মতবাদের পিছনে দর্শন - সমর্থিত কোন যুক্তি কিন্তু নেই। এছাড়া, ঈশ্বরকে অস্বীকার করার কোন উদ্দেশ্য, আমাদের কবির কোথাও দেখা যায়নি বরং ঈশ্বরকে  স্বীকার করে চিরন্তন সত্যকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করার একটা অন্তরঙ্গ প্রচেষ্টা আমরা নজরুলের 'বিদ্রোহবাদে' লক্ষ্য করে থাকি। কোন দুরন্ত শিশুর মায়ের উপর যখন রাশিকৃত অভিমান থাকে, মাকে তখন সে অগ্রাহ্য করে। এটাই তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এই ধরণের অস্বীকৃতি মাঝে - মধ্যে দেখা গেলেও সেটি কিন্তু মায়ের প্রতি সন্তানের অভিমান ছাড়া যেমন অন্য কোন কিছু হতে পারে না, ঠিক তেমনি আমাদের কবির ঈশ্বরকে ক্ষণিক অস্বীকার করাটা কখনোই কবির ঈশ্বরের উপস্থিতিকে পূর্ণতঃ অগ্রাহ্য করার দ্যোতক নয়, সেটি ঈশ্বরের প্রতি আমাদের কবির অভিমান মাত্র। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই এই সত্যটি আমাদের মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই ধারণাকে কোন ক্রমেই কবির 'নাস্তিকতা' বলে মনে করা যায় না। অন্য দিকে, চিরন্তন সত্যকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, পাশবিক শক্তিকে প্রতিহত করার ক্ষমতা লাভের জন্য আমরা আমাদের কবিকে ঈশ্বরের কাছে শক্তি ভিক্ষাও করতে দেখি। এই কারণে আমরা কবির বিদ্রোহবাদকে নাস্তিক্যবাদ না বলে  যথার্থ আস্তিক্যবোধক‌ই বলবো। এর একমাত্র কারণ হলো, প্রবল ঔচিত্যবোধ থেকেই নজরুলের কাব্যে বিদ্রোহ একটি ব্যতিক্রমী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।  তাঁর বিদ্রোহের মূলে রয়েছে মানুষের প্রতি অপরিমিত শ্রদ্ধাবোধ। এই কারণেই তাঁর রচনায় বিদ্রোহ, নিছক বিদ্রোহ নয়, মানবিকতার জয়গানে সজীব হয়ে বিদ্রোহ এখানে আমাদের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। 


কখনো - কখনো, আমাদের মনে হয়েছে যে তাঁর বিদ্রোহ, শুধুমাত্র তৎকালীন ইংরেজ - সরকারের বর্বরতাকে কেন্দ্র করেই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই ধারণাটি নিঃসন্দেহে পূর্ণতঃ পক্ষপাত দুষ্ট। থিতিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে শুধুমাত্র ইংরেজ সরকারের অন্যায় - অবিচারকে কেন্দ্র করে কবির 'বিদ্রোহভাব' আবর্তিত হয়নি বরং আমাদের ভারতভূমিতে তৎকালে বহুল প্রচলিত ধর্ম - ব্যবস্থায়, সমাজ - ব্যবস্থায় আর সাহিত্যের সুবিশাল ক্ষেত্রে বহুধা প্রচলিত নানা ধরণের গোঁজা - মিল, জোড়া - তালি, গড়া - পেটা, অনাচার, অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলতা - আমাদের কবি যেখানে‌ই লক্ষ্য করেছিলেন, তাঁর বাঁধনহারা কণ্ঠ সেখানেই গর্জন করে উঠেছিল। কবি বলেছিলেন, "যেথায় মিথ্যা ভন্ডামি ভাই, করবো সেথায় বিদ্রোহ। ধামা - ধরা ! জামা - ধরা! মরণ - ভীতু! চুপ্ রহো।" অর্থাৎ আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করবো যে কবির বিদ্রোহ কোন দিক থেকেই একমুখিন নয়, বহুমুখিনতা নিয়ে আজ‌ও আমাদের সাহিত্য জগতে এক এবং অদ্বিতীয় হয়ে আছে।


No comments:

Post a Comment

বর্ণপরিচয়